Thursday, December 21, 2017

৭ম পর্বঃ আমার চোখে নাফি- (২)

পানি আর বিদ্যূতবিহীন জ্যৈষ্ঠ্যের খর-তাপে পোড়া দুপুরটাকে আজ অন্যরকম লাগে। অন্য দশটা দিনের সাথে কোন মিল নেই। ঢাকার তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বাতাস বইছে না। গাছগুলো পাতা কাঁধে নিয়ে বিমর্ষ দাঁড়িয়ে- তাপদগ্ধ, প্রাণ করতলে। আমাদের মতই। এলাকায় বিদ্যূৎ নেই সকাল থেকে। বিদ্যূৎবিহীন সকালগুলোকে ঠিক লবনবিহীন পান্তার মত পানসে লাগে! শুধু চুপচাপ গিলে যাও! তার উপরে গতকাল থেকে পানি নেই এই ফ্ল্যাটে। প্রথম কারণ- ট্যাংকি পরিস্কার করতে হবে। সেটা প্রায় সারাদিনের কাজ। অথচ বাড়িওয়ালা কাউকে সেই মেসেজটা পর্যন্ত দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। আমাদের যেটা হলো- হঠাৎ ভয়ন্কর ময়লা পানি আসতে শুরু করার পর আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। ড্রামে যে পানিটুকু ছিল তাও নষ্ট হয়ে গেল। দ্বিতীয় কারণ- সারাদিন ধরে ট্যাংকি পরিস্কার করে, রাতে পানি দিতে গিয়ে- পানির মটরটাই জ্বলে গেল। কখন ঠিক হবে- কেউ জানে না। ঘরের ভিতরে আঁটকে থাকা গরম-গুমোট বাতাসটার ওজন বেড়ে গেছে মনে হয়। হাতপাখা চালিয়ে বাতাস করে যাচ্ছি নাফিকে। সেই সংগে নিয়ম মাফিক নাফির জন্যে গানও গাইছি। কিন্তু ভাল বোধ করছি না বলে, অনেকটা আবেগহীনভাবে দু’টো গানই বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গাইছি– “কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া” এবং “চোখের আলোয় দেখেছিলাম চোখের বাহিরে।” মাঝে মাঝেই গানের লাইনও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। লাইন ভুল হলে সাথে সাথে নাফির দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি- তার কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি-না! আমাদের চার চোখের মিলন হলে, আমি ওকে হাসি উপহার দিচ্ছি। কিন্তু আমার হাসির প্রত্যুত্তরে সে প্রতিক্রিয়াহীন। গম্ভীর।
ওর গায়ের জামাটা ঘামে ভিজে সপসপে হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা খুলতে দিতে রাজী নয় সে কোনভাবেই। পাখার বাতাসটা ওর ঠান্ডা লাগার কথা। সে চুপচাপ। শুয়ে শুয়েই হাতের কার্ডগুলো নিয়ে আপন মনে খেলছে। সমস্ত মনোযোগ দু’হাতের আংগুলে ধরা কার্ডের দিকে। তার মাথা এবং পিঠের নিচে বালিশ-বিছানা ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই সে উঠে বসে খেলতে খেলতে অনবরত শরীর দোলাচ্ছে। অটিস্টিকদের বেলায় ক্রমাগত হাত বা পা নাড়ানো, একা একা নিজে নিজে নড়তে থাকা বা শরীর দোলানো, একা একা এক জায়গায় ঘুরতে থাকা, নিজের শরীরকে নিজে চেপে ধরা বা কোন নির্দিষ্ট শব্দ বা কয়েকটি শব্দ ক্রমাগত বলতে থাকা –এ’সব খুব common দৃশ্য। এ আচরণগুলোকে stimming বলা হয়। Stimming বলতে সহজ ভাষায় Self-stimulatory behavior বা আচরণকে বোঝায়, যাকে অনেক সময় stereo-type আচরণও বলা হয়।
আমি ঘামছি খালি গায়ে। কালো শরীরটা ভেজা, চকচকে। কল-কল করে ঘাম নেমে যাচ্ছে কোমরে। সেখানে জিনসের ট্রাউজারটা ঘাম শুষে নিতে-নিতে গাঢ় নীল হয়ে গেছে। বারান্দায় এসে উঁকি দিয়ে দেখছি জয়ীকে দেখা যায় কি-না। মায়ের সাথে সে গোসল করতে নানু বাড়িতে গেছে। নাহ্, দেখা নেই ওদের। ফোন দিতেই সেটা রিসিভ করলো জয়ী। জিজ্ঞেস করলাম- আর কতক্ষণ লাগতে পারে? মিষ্টি করে বললো “ আম্মু বাথরুমে। আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবো। কেন তোমার ক্ষুধা লেগেছে, দীপু?” কী বলবো- খুঁজে না-পেয়ে বললাম- “না তো, মা। ক্ষুধা লাগেনি। সব ঠিক আছে। তোমরা এসো। ঠিক আছে- আমি রাখছি।” জয়ী এবং তার মা এলো আধাঘন্টা বাদে। প্রায় সাথে সাথে বিদ্যূৎ এবং পানিও এলো! আমিও সিকোয়েন্স অনুযায়ী আমার ছেঁড়া টি-শার্টটা পরে নিলাম। গুটিয়ে রাখা জানালার ভারী পর্দা ফেলে দিয়ে ঘর অন্ধকার করে দিলাম। কিন্তু অনেক যন্ত্রনার পর পাওয়া সব আনন্দ ছিঁড়ে-ফুঁড়ে জয়ী ঘোষনা দিল- সে আর তার ভাইয়ার পছন্দে জামা-কাপড় পরবে না। কোনভাবেই না। ফলে সে বেছে নিল- একটা নীল টি-শার্ট। সাথে কালো রংয়ের ট্রাউজার। ওকে আমি সমর্থন করতে পারছি না কারণ, নাফি রিয়েক্ট করতে পারে- এটা ভেবে। আবার মনে হলো- ঠিক আছে। পরুক না কিছুক্ষণ। নাফির থেকে একটু চোখের আড়ালে থাকলেই তো হলো! ছোট্ট মানুষটা আর কতক্ষণ সব মেনে নিয়ে চলবে? নাফি চাইলে আবার না হয় পরবে- কিংবা তখন দেখা যাবে! আমি সায় দিলাম- “ঠিক আছে মা পরো। কিন্তু তুমি ঐ রুমে যেও না। এদিকে থাক।” তার তাৎক্ষণিক উত্তর- “কেন যাব না। আমি কি বাইরের মানুষ? তুমি ভাইয়াকে বলে দাও, আমি আমার পছন্দমত জামা কাপড় পরবো।” আমার কন্ঠে ভয় এবং বিরক্তি- “আহ্-হা, জয়ী! তুমি বোঝ না। আমি তোমাকে যেটা বললাম- তুমি সে’ভাবে চলবে। একদম বুঝতে পারছো না তুমি- তোমার ভাইয়া দেখলে কী হতে পারে!”
জয়ী তার পছন্দের জামা-কাপড় পরার পর থেকেই আমার সমস্ত মনোযোগ দু’জনের উপরেই পালা করে ঘুরছে। কিন্তু শেষ রক্ষাটা হলো না। নাফির চোখে জয়ী ধরা পড়ার সাথে সাথে সে উঠে দাঁড়ালো। ওর পরবর্তী প্রতিটা ধাপ আমার মুখস্ত। আমি জানি- ও এখন কী কী করবে। আমি দ্রুত চলে গেলাম ওর কাছে। ততক্ষণে নাফি ছুটে গিয়ে জয়ীর খুলে ফেলা জামা কাপড় গুলো হাতে নিয়ে, আপাত-দৃষ্টিতে শান্তভাবেই শুধু জয়ীর দিকে হাত বাড়িয়ে ধরে আছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি- নাফি আসলে breaking point-এর কাছাকাছি চলে এসেছে। দূর্ভাগ্য আমার, সেটা আমি ছাড়া আর কেউ ধরতে পারে না। কারণ- বাইরে থেকে ওকে একদম শান্ত দেখায় এ’সময়ে। কিন্তু ভিতরের মানুষটা এখন বিস্ফোরণ উন্মুখ একটা টাইম বোমার মতই! শুধু জয়ী প্রকাশ্যে আপত্তি জানালেই বিস্ফোরণটা ঘটে যাবে। আমি দ্রুত ওর হাত থেকে জয়ীর কাপড়গুলো নিয়ে কৃত্রিম আদেশের মত করে বললাম- “জয়ী যাও, এ’গুলো পরে এসো।” নাফি আমার পিছনেই দাঁড়ানো। সে মাইন্ড রিডিং ভালই জানে। তাই সে স্পষ্ট পড়তে পারছে জয়ীকে। আমার ভিতরে চেপে রাখা টেনশন আর অবচেতনে যুদ্ধের প্রস্তুতি! ঠিক জয়ী যে মূহুর্তে বিরক্তি প্রকাশ করে নাফির দেয়া পোশাক পরতে আপত্তি জানালো- আমার পিছনে মনে হলো বোমা ফাটলো। আতকিংত হওয়ার মতই ভয়ন্কর এক চিৎকার দিয়ে বিস্ফোরণটা ঘটিয়ে দিল নাফি। শুরু হলো সে’দিনের যুদ্ধ। প্রথম আক্রমণটা আমাকেই করলো। এরপর আমাকে ছেড়ে প্রচন্ড জোরে-জোরে থাপ্পড় মারতে শুরু করলো- নিজের কান, মাথা আর গাল জুড়ে। প্রায় ঘন্টা তিনেকের যুদ্ধের পরে আবিষ্কার করলাম- নাফির গালটা ফুলে গেছে ওর ক্রমাগত স্বঘাতের ফলে। জয়ী, ভাইয়ার দেয়া সেই জামা-কাপড় পরে, ভয়ে গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে বিছানার কোণায়- দেয়াল ঘেঁষে। আমার ছেঁড়া টি-শার্টটা নতুন করে আরো দু’জায়গায় ছিঁড়েছে। বীনা ক্লান্ত শরীরে বারবার রান্নাঘরে যাচ্ছে আসছে আর একটু পর পর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে- উফ্ শব্দে। কিন্তু আমি সে’দিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক আবিস্কার করে দারুণ হালকা বোধ করছি ভবিষ্যতের যুদ্ধের কথা ভেবে। সেটা হলো- ওর হাত দু’টোকে বেঁধে নিয়ে ল্যাং মেরে ওকে বিছানায় শুইয়ে ভাল করে ঠান্ডা পানি দিয়ে শান্ত না-হওয়াবধি মুছতে থাকা। ঠেসে ধরে নিয়ন্ত্রণের কৌশলটা অনেকেই প্রয়োগ করে। আর আমি সেটা শিখেছিলাম ইউটিউব থেকে। সেটার সাথে প্রচুর শক্তির অপচয় ঘটে। কিন্তু আমার সদ্য আবিস্কৃত এই কৌশলটা অনেক ভাল কাজ করেছে। আসলে যে পরিবারে একটা অটিষ্টিক সন্তান থাকে সে পরিবারে প্রায় প্রতিটি দিনই হয় যুদ্ধের। আর আমাদের পুরো জীবনটাই তাই যুদ্ধের কাল! কিন্তু বারবারই হেরে যাই নিজের কাছে যখন ভাবি- আমার এবং বীনার মৃত্যুর পরে- নাফির কী হবে! (চলবে)

No comments:

Post a Comment