Thursday, December 21, 2017

২য় পর্বঃ নিস্তব্ধ নিশি।। (আত্মকথাঃ ফারহান আরিফ নাফি)

গভীর রাত। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। বসে আছি আমার মাথায় ব্যবহার করা তিনটি বালিশের উপর। সেগুলি একটার উপরে আরেকটা- এ’ভাবে রাখা। ফ্লোরেই- এবং রুমের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ ঘেষে আমার ৮ফিট বাই ১০ফিটের বিছানা। দেয়ালের সাথে লাগোয়া বলে, কোণ ঘেষেই বালিশগুলো পাতা থাকে। মাথার পিছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছি। অনেকটা চেয়ারে বসার মত করে- হাঁটু ভাজ করে, দু’পা সামনে রাখা। ডিম লাইটের আলোয় অদ্ভূত কালচে-নীলাভ এই আলো-অন্ধকারে বসে আমার চারপাশের সবকিছুকে অনুভব করছি। উচ্চ শব্দগুলো এই সময়ে থাকে না। কিন্তু নিচু অনেক শব্দ আছে আমি শুনতে পাই। সাধারণ মানুষগুলো এইসব শব্দের বেশীর ভাগই শুনতে পায় না। তবে খেয়াল করলে তারাও নিশ্চয়ই কিছু শব্দ শুনতে পায়। কিন্তু আমার সংবেদনশীল কান প্রকৃতির অনেক শব্দ শুনতে পায়। দিনের আলো ফুটতে শুরু করার সাথে সাথে পৃথিবীটা যখন জেগে উঠতে শুরু করে, ধীরে ধীরে তার শব্দও বাড়তে থাকে- দ্রুত। এর অল্প কিছুক্ষণ পরই পৃথিবীটা বিশ্রী রকমের শব্দময় হয়ে ওঠে। আমি সকাল থেকেই দু’কানে আংগুল দিয়ে আমার প্রাত্যহিক কাজকর্ম শুরু করি। তাই, রাতের এই নিস্তব্ধতা আমার কাছে খুব অন্যরকম মনে হয়। ভাল লাগে। কিন্তু দিনে এবং রাতে মিলিয়ে সব সময়- এমন শান্ত এবং সুন্দর একটা পৃথিবী হয় না। হলে ভাল হতো! সেই পৃথিবীটার কথা আমি কাউকে কোনদিন বলতে পারবো না। তোমাদের কেউই কোনদিন কল্পনাও করতে পারবে না- “সেই পৃথিবীটা কত সুন্দর!
উচ্চ শব্দ থেকে কান ঢাকতে আমি যে বালিশটা ব্যবহার করি- সেটা এখন বুকের সাথে চেপে ধরে আছি। চিবুকটা নামিয়ে দিয়েছি বালিশের কানিতে। মাঝে মাঝে মুখটা তুলে দেখছি শান্ত চারপাশ। শব্দহীন দাড়িয়ে আছে ওয়াড্রোবটা। সারাদিন ওটার ড্রয়ারগুলো বহুবার খোলা হয়। সেও বিশ্রাম করছে। আমি অনেকক্ষণ ওয়াড্রোবটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মনে হচ্ছে ওর-ও প্রাণ আছে। আছে সুখ-দুঃখ, অনুভূতি। আমার মাথার কাছে, ঠিক ওপরেই আমার লাইফ-সাইজের একটা পোষ্টার আছে। সেখানে ছোটবেলার আমি। এটা আমার ৭ বছর বয়সের ছবি। ছবিতে হালকা হাসিমুখে, বড়-বড় চোখে তাকিয়ে আছি। ছবির ‘আমি’ সারাক্ষণ আমার দিকেই তাকিয়ে থাকে। যতবার তাকাই ততবারই দেখি সে আমাকেই দেখছে, আর আমি তাকে। এই অন্ধকারেও ওর দিকে একবার তাকালাম। আগের মতই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এটাই ওর একমাত্র কাজ- আমার দিকে তাকিয়ে থাকা। এই সময়টাতে টিভির মনিটরকে কুচকুচে কালো দেখায়। সারাদিনে ঘুরে ফিরে সবাই বারবার চোখ রাখে টিভিতে। টিভিটাও একের পর এক তার রকমারী এবং দুর্বোধ্য নানারকম ছবি দেখাতে থাকে। আমার মনে হয়- টিভিটার ঠিক ভিতরে কোথাও বিশাল একটা ভান্ডার রয়েছে এ’সবের। আর সে’ ভান্ডার থেকে যখন বাংলায় কিছু হয়, বিশেষ করে- ধীর লয়ের কিছু গান, সে’সব আমার ভাল লাগে। কিন্তু আমার ভাল লাগাটা যেহেতু আমি বোঝাতে পারি না, তাই এই বিষয়টা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মাঝে মাঝে অবশ্য বীনু-আম্মু কিংবা দীপু-পাপা আমার কথা বলে- ‘নাফি এটা পছন্দ করছে। ও দেখুক।’ আমি রিমোটের ব্যবহার জানি না। তাই আমি বাদে সবাই, বেশীরভাগ সময়েই, যে যার নিজের পছন্দ মত চ্যানেল দেখে। কিন্তু কখনো আমার ভাল লাগছে- এমন কোনকিছু যখন দেখছি, তখন দুম করে সেটা পাল্টে দিতে পারে যে কেউ। এবং দেয়ও। আমি নির্বিকার থাকি। অন্য কোথাও মনোযোগ দেই। সাধারণতঃ রিমোটটা হাতে নিয়েই কে কোন-কোন চ্যানেলগুলোতে যাবে- সেটা আমি অনুমান করতে পারি। আমার ছোট বোন জয়ী- সে রিমোট হাতে নিয়েই কার্টুন চালিয়ে দিবে। সে অবশ্য মাঝে মাঝে দীপু আর বীনুর সাথে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, স্টার মুভিজ এবং এইচবিও দেখে। আমি কিছু চ্যানেলের নাম জানি, কারণ, এই নাম গুলো বহুবার উচ্চারিত হয়েছে- আমি বাদে, ঘরের বাকী সবার মুখে।
সময়ের ব্যাপারটা আমি বুঝি না। তাই কয়টা বাজে জানি না। নিঃশব্দের ভিতর একমাত্র শব্দ হয়ে জেগে আছে শুধু সিলিং ফ্যানটা। ওটাকেও জীবন্ত মনে হয়। একাকীই নিজের কাজটা করে যাচ্ছে অনবরত, বিরামহীন। এরপর চোখ ফিরিয়ে তাকালাম আমার বুকের সাথে ধরা বালিশটার দিকে। একটা অদ্ভূত রকমের আপন-আপন ঘ্রান আছে এটায়। ভীষন টানে আমাকে। আমার সাথে দীর্ঘদিন ধরে আছে এই বালিশটা। এবং আমার অনেক আপন কিছু এটা। কোনভাবেই আমি এটাকে হারাতে চাই না। এমন কী ছিঁড়ে গেলেও না। আরও জোরে চেপে ধরলাম ওকে আমার বুকের সাথে। চেপে ধরেই- ধীর লয়ের কোন গানের সুরের মত গুনগুন একটা শব্দ করে যাচ্ছি। সমস্ত মনোযোগ দিয়ে আমার নাক-মুখ ঘষছি বালিশটার সাথে। হঠাৎ মনে হলো দীপু পাপা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ কোন শব্দ বা নড়াচড়া করেনি সে। তার দিকে না তাকিয়েও নিশ্চিত করে বলতে পারি সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! আমার অতিচেতনার অংশ আমাকে সেটা জানিয়ে দেয়। অনেক সময়েই- তাই আমি না-দেখলেও, অনেক কিছু বুঝতে পারি- এই যেমন এখন বুঝতে পারছি দীপু পাপা আমার দিকে তাকিয়ে আছে একভাবে। অথচ একটি বারও আমি তার দিকে তাকাইনি। কোন শব্দও পাইনি। সে শুয়ে আছে বড় খাটটায়। তার পাশে বীনু এবং বীনুর বাম পাশে জয়ী। কেন জানি রাতে দীপু ঘুমায় না। সারারাতই প্রায় জেগে কাটায়। কিন্তু আজ সে একটু আগেও ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি এটাও জানি- আমি উঠে দাঁডানো মাত্রই সেও উঠে আমার পিছু নেবে। সহানুভূতিমাখা নরম সুরে জানতে চাইবে- “কী হয়েছে, বাবা? আমাকে বল।” আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। ঠিক তাই, দীপু পাপা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ডিম লাইটের হালকা নীলাভ আলোয় আমাদের চোখাচোখি হলো। কিন্তু সে কোন কথা বললো না। শুধু তাকিয়েই আছে। জানি তার ভাবনার জগত জুড়ে এখন কেবল আমি। সে আমার সমস্ত ভাবনাগুলো বুঝতে চায়। আমার ভিতরে ঢুকে পড়তে চায়। কিন্তু আমি আমার অতিন্দ্রিয় চেতনার কারণে তার মনকে স্পষ্ট পড়তে পারছি। দীপু এই মূহুর্তে ভাবছে - “কোন ভয় নেই, আব্বু। - এই যে, আমি আছি!”
এরপর সে নেমে এসে বলবে- “ঠিক আছে, ঘুরে শো-ও আব্বু ।” আমি পু্ব-দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে কাত হয়ে শুলাম। সিকোয়েন্সের পরের অংশটা হলো- ও এখন আমার পিঠ চুলকাতে-চুলকাতে নিচু স্বরে গান গাইবে। নিচু স্বরেও সে ভাল গায়। সে গাইছে-
                            পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায় 
                         সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আজ ওর গান খুব ভাল হচ্ছে। অনেক ভালো লাগছে আমার। ওর গানের তালে আমার দুলতে ইচ্ছে করছে। আমি ঘুম বাদ দিয়ে দুম করে উঠে বসলাম। এরপর সেই গানের সুরে সুরে ভীষণভাবে দুলতে থাকলাম- নিঃশব্দে। ঠিক দীপুর চোখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। কিন্তু, আর… বাকী সবাই- সবার পৃথিবী তখন নিঃশব্দ আর তন্দ্রায় নিমজ্জিত। এরপর দীপু আরো কয়েকটি গান গাইল এবং পিঠ চুলকাতে থাকলো। একসময়ে আজান শুনলাম। দীপু থামলো। আমি শুয়ে পড়লাম। চৈত্রের ভয়ন্কর এই গরমেও মোটা ব্লান্কেটটা টেনে নিলাম গলা পর্যন্ত। অথচ ঘরের তাপমাত্রা এখন ৩১ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছুঁই ছুঁই। আমি ঘামছি। তাতে কোন সমস্যা নেই। ব্লান্কেটটা ব্যবহার করি মূলতঃ আমার শ্পর্শকাতর ত্বকের কারণে। ঠান্ডা, গরম এবং স্পর্শ- আমি একবারেই সাধারণ মানুষের মত অনুভব করি না। তা’ছাড়াও ব্লান্কেটের ব্যবহার আমাকে একটা নিরাপত্তা বোধের অনুভূতিও দেয়। ঘুমের আগে এটাই ছিল আমার শেষ ভাবনা। এ’ ভাবনার প্রায় সাথে সাথেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। (চলবে)

No comments:

Post a Comment