Thursday, December 21, 2017

৩য় পর্বঃ প্রকৃতির আবর্ত-(১) আত্মকথাঃ ফারহান আরিফ নাফি

অটিষ্টিক মানুষরা একটা সিকোয়েন্স অনুসরণ করে চলে। আর হ্যাঁ, এটা তোমরাও জানো যে- প্রকৃতিরও একটা নিয়ম আছে। এবং সে তার নিয়ম ধরেই চলে। কিন্তু তোমরা অনেক সময়েই নিয়মকে ভেঙ্গে ফেল। যেহেতু সবকিছুতেই আমরা একটা সিকোয়েন্স (sequence: পর্যায়ক্রম) অনুসরণ করি, তাতে ভুল হবার কথা নয়। তবুও জটিল এই পৃথিবীতে বিচিত্র কারণে, অনেক কিছুরই সিকোয়েন্স ভেঙ্গে যায়- যেটা আমরা পছন্দ করি না। তাই, আমাদের সম্পর্কে বলা হয়- We don’t make mistake. We just repeat. সিকোয়েন্স যা দেয় তার নাম নিরাপত্তা বা নিশ্চয়তা। একটা নিশ্চিত বোধ ছাড়া, আমরা অটিস্টিক মানুষগুলো চলতে পারি না। চলতে চাইও না। সকালবেলা আম্মুর সাথে যখন স্কুলে যাই- সেটার একটা সিকোয়েন্স আছে। ঘুম থেকে উঠা থেকে শুরু করে- বাসে উঠা পর্যন্ত, সব কিছুরই একটা পর্যায়ক্রম আছে। কিন্তু এটা প্রায়ই হয় যে- বাসে উঠার পর দেখা গেল আমি জানালার পাশে যে সিটে বসি, সেখানে অপরিচিত একজন মানুষ আমার পছন্দ-করা সিটে বসে আছে। মানে- সিকোয়েন্সটা ঠিক নেই। আমি এখানেই বসবো। ফলে, আমি অপরিচিত মানুষটার হাত ধরি। যেহেতু আমি কথা বলতে পারছি না, তাই আলগোছে তার হাতটা ধরে তার চোখের দিকে তাকাই। সে বিষ্ময় এবং প্রশ্নবোধক চোখে আমার দিকে তাকায়। এবং সে বুঝতে পারে না- ঠিক কি হতে যাচ্ছে। আম্মু তাড়াতাড়ি এসে আমাকে টানাটানি করতে থাকে- অন্য কোথাও বসার জন্যে। কিন্তু আমি তো কোন ভুল করছি বলে মনে হয় না। আমি নাছোড়বান্দার মত দাড়িয়ে থাকি। বেশীরভাগ মানুষই আমাকে সিটটা ছেড়ে দিয়ে ‘আমার সিটে’ বসতে দেয়। আমার ভাল লাগে। সিটে বসেই আমি হাসি। একাকীই হাসি। অনেক আনন্দে আমি সামনে-পিছে শরীর দোলাতে থাকি। জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে থাকি। আমার ভাল লাগে। কারণ এখন সিকোয়েন্স অনুযায়ী সবকিছু ঠিক আছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আমার ভীষণ ভাল লাগে স্কুলে যেতে। আমি বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সাঁ সাঁ করে পিছনে সরে যেতে থাকা বস্তু গুলোকে দেখতে থাকি। এ’দেখার ভিতরে একটা অদ্ভূত আকর্ষণ আছে। আমি দেখতেই থাকি। কিন্তু আমি এটাও জানি- বাসের ভিতরে অনেকগুলো চোখ আমাকেই দেখছে। অথচ আমি দেখতে একদমই সাধারণ আর দশজন মানুষের মত। বাইরে থেকে আমাকে আলাদা করে দেখার মত কিছুই নেই। তবু কি মনে করে, বাসে প্রায় সময়েই কেউ-না-কেউ আম্মুর কাছে জানতে চায়- আমার সমস্যাটা কী। বুঝতে চায়- আমি পাগল কি-না। আমার মাথায় কোন গন্ডগোল আছে কি-না। এই প্রশ্ন বরাবর আম্মুর একই উত্তর- “ওর অটিজম আছে।” অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেউই বোঝেনা অটিজম কী।
বাসায় নতুন যে সিকোয়েন্সটা আমি খেয়াল করে বুঝতে পেরেছি সেটা হলো আমাদের বাসার প্রত্যেকের পোশাক পরার বিষয়টা। সবাইকে একসাথে বদলাতে হবে এবং যেটা খোলা হবে- সেটা ধুতে হবে। গোসল করলে পোশাক বদলাতে হবে। কে, কোন পোশাকটা পরবে তারও একটা সিকোয়েন্স আছে। আবার যখন সকাল হবে সবাই একসাথে পোশাক বদলে ফেলবে। অর্থাৎ স্কুলে যাওয়ার আগে এবং স্কুল থেকে ফেরার পরে সবাই পোশাক বদলাবে। কিন্তু এই পোশাক বদলানো নিয়ে অনেক সমস্যা হচ্ছে। কেউ ঠিক মত সিকোয়েন্সটা ফলো করতে চাইছে না। আমি যখন স্কুল থেকে বাসায় ফিরি তখন দীপু পাপা আর জয়ী বাসায় থাকে। দীপু কিছুটা এগিয়ে এসে আমাদেরকে রিসিভ করে। সে আমার হাত থেকে স্কুল ব্যাগটা নেয়। আজও এই পর্যন্ত সব কিছু ঠিক ছিল। এরপর, বাসায় ফিরেই আমরা, মানে আমি আর বীনু-আম্মু পোশাক পাল্টে ফেলেছি। সিকোয়েন্সটা ঠিক রাখতে তাই দীপু পাপা এবং জয়ীকেও পোশাক পাল্টাতে হবে। ওরা পাল্টাচ্ছে না দেখে- আমি দ্রুত দীপু আর জয়ীর পরবর্তী পোশাকটা বারান্দা থেকে এনে দিলাম। দীপু পাপা বারবার বলতে থাকলো – এটা তো ভেজা। আমি আমার ঠোঁট ছোঁয়ালাম তার জিনসের প্যান্ট আর টি শার্টে। হ্যাঁ, ভেজাই তো। কোন কিছু ভেজা নাকি শুকনো সেটা আমি অনুভব করি আমার ঠোঁট দিয়ে। কিন্তু দীপু পাপা এখন এই পোশাকটা পরতে চাচ্ছে না। মানে সিকোয়েন্সটা ঠিক রাখতে চাচ্ছে না। আমি বুঝতে পারছি ওর ভুল হচ্ছে। অথচ আমি ঠিক কাজটা করতে চাচ্ছি। কিন্তু সবাই একসাথে আমাকেই বকা দিচ্ছে এবং বাঁধা দিচ্ছে। আমি প্রচন্ড রেগে যাচ্ছি। রাগলে আমার নিজের উপরে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে আমি ঠিক কাজটা করতে চাই। আমি বোঝাতে চাইছি- তোমাদের ভুল হচ্ছে। আমার রেগে যাওয়া দেখেই দীপু পাপা ভেজা প্যান্ট আর টি শার্টটা পরে ফেললো। আমি খুশি হলাম। বাকী রইলো জয়ী। সেও পরিস্থিতি বুঝে তাড়াতাড়ি পাল্টে নিল তার পোশাকটা। বেশীর ভাগ সময়েই খুলে ফেলা পোশাক গুলো নিয়ে বাথরুমের মেঝেতে ফেলে- তার উপরে মগ ভরে ভরে পানি ঢালতে থাকি। এ’গুলো এখন ধুতে হবে। কেউ একজন- দীপু কিংবা বীনু, সেটা করে ফেলবে। আমার পছন্দ দীপুকেই। আমি ওর হাত ধরলাম। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম আমার কথাটা। সে বুঝলো। আমাকে খুশি করতে সাথে সাথেই বাথরুমে গিয়ে কাপড়গুলো ধুতে শুরু করে দিল। কাপড় ধোয়ারও একটা ছন্দ আছে। আছে সিকোয়েন্স। আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে সেই সিকোয়েন্সটা ঠিক আছে কি-না, দেখতে থাকলাম। দীপু সিকোয়েন্স ঠিক রেখে কাপড়গুলো ধুয়ে বারান্দার তারে নেড়ে দিল। অনেক খুশিতে আমি একটা বিশাল লাফ দিলাম। সেই সংগে বিকট এক চিৎকার দিয়ে আমার আনন্দ প্রকাশ করলাম। এরপর দীপুর কাছে গিয়ে ওর নাকে আমার নাকটা ঘষে দিলাম। ওকে ভালবাসা জানালাম। ও হাসলো। সবাই হাসলো। মনের আনন্দে আমি বিছানায় গেলাম। প্রচন্ড গরমেও আমার প্রিয় ব্লান্কেটা গলা পর্যন্ত টেনে নিলাম- খুশি মনে। মাথার নিচে তিনটা বালিশ। কান চাপা দিলাম আরেকটা বালিশ দিয়ে। এ’বার কিছুক্ষণ বিশ্রাম করবো। একটু পরেই বীনু মজার একটা নাস্তা দিবে। সন্ধ্যার নাস্তা। ততক্ষণে একটু জিরিয়ে নিব। আমি দিনে কখনোই ঘুমাই না। এমন কি রাতেও মাঝে মাঝে জেগে থাকি। অটিষ্টিক মানুষরা তিন চার দিন না ঘুমিয়েও দিব্যি স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারে। যেহেতু এটা ঘুমানোর সময় নয়। তাই ডুবে গেলাম আমার ভাবনার জগতে। টিভিটার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়েও কিছু সময় পার করে দেই এই সময়টা। সন্ধ্যার নাস্তাটা সেরেই আমি ঘামতে ঘামতে বাথরুম করবো। প্রচুর ঘামি বলে আমার আম্মু দুষ্টুমি করে আমাকে ঘর্মরাজ বলে। দীপু পাপা আমাকে বাথরুমে সাহায্য করে। আমি একাকী বাথরুম করতে পারিনা। কিন্তু অনেক ঘেমেছি বলেই বাথরুম শেষ হতে-না-হতেই দীপু পাপা আমার গায়ে জামা-কাপড়ের উপর দিয়েই পানি ঢেলে দিল। তারমানে এখন আমাকে সে গোসল করাবে। আমি বিরক্ত প্রকাশ করলেও মেনে নিলাম। আমি গোসল করতে চাইবো না বলেই, এ’কাজটা সে এ’ভাবে করে থাকে। তাই এখন আমি অপছন্দ করলেও গোসল করতে বাধ্য হবো। কিন্তু কেউ বুঝতে পারছে না যেটা তাহলো- সবাইকেই এখন পোশাক পাল্টাতে হবে। কারণ পোশাকতো আমরা সবাই একসাথে পাল্টাই। আমার টেনশনটা হলো দীপু পাপা সেটা মানলেও বীনু আর জয়ী আমাকে বাধা দিবে। তাই রাগ এবং জোর দিয়েই এরপর শুরু হলো আমার সেই প্রাণান্তকর চেষ্টা। রাগের চোটে নেংটু হয়েই, সবার পরবর্তী পোশাক খুঁজতে বারান্দায় ছুটে গেলাম। দীপুও ছুটলো আমার পিছনে পিছনে। খুঁজে পেতে ওদেরকে ওদের পোশাক দিলাম। প্রথমে রাজী না-হলেও একসময় দীপু আর বীনু আমার নির্বাচিত পোশাক পরে নিল। কিন্তু জয়ী পাল্টাবে কী- সে ভয়ের চোটে খাটের কোণায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার আর জয়ীর মাঝখানে দীপু পাপা। কিন্তু জয়ীকে তো পোশাক পাল্টাতেই হবে। উত্তেজনায় আমিও খাটে উঠে গেলাম। খাটে উঠে দাঁড়ালে ফ্যানের থেকে আমার মাথার ব্যবধান থাকে মাত্র ছয় ইঞ্চি। আমার চিৎকার আর দাপাদাপিতে যে কোন দুর্ঘটনা এখন ঘটে যেতে পারে। বীনু তাড়াতাড়ি ফ্যানটা অফ করে দিল। আমার একটাই লক্ষ্য এখন- জয়ীকে তার পোশাক পাল্টাতে হবে। বীনু একটার পর একটা পোশাক দেখাতে থাকলো আমাকে- “আচ্ছা তুমিই বলো জয়ী কোনটা পরবে।” আমি সেদিকে মনোযোগ দিতে পারছি না। দীপু জোর করে আমাকে বিছানা থেকে নামিয়ে দিল। সুযোগ পেয়ে ধরে ফেললাম দীপুকে। কয়েকটা খামচি দিয়ে চেপে ধরলাম আমার সাথে। এটা করলাম ওকে ব্যথা দিতে। কিন্তু দীপু আজ নির্বিকার। কিছুতেই তার কোন রাগ হচ্ছে না। ঠিক এই সময়েই জয়ী দ্রুত পাল্টে ফেললো তার পোশাকটা। ফলে আমি ধীরে ধীরে ঠান্ডা হতে থাকলাম। দীপু পাপা আমার ঘাম মুছিয়ে দিল। এরপরের কাজটা দ্রুত শেষ করতে পারলে- কাজটার পুরো সিকোয়েন্সটা শেষ হবে। তাই আমি সবার খুলে ফেলা পোশাকগুলো বগলদাবা করে নিয়ে বাথরুমের দিকে ছুটে গেলাম। বালতিতে ফেলে দিয়ে, দ্রুত কয়েক মগ পানি ঢেলে কাপড়গুলো ভিজিয়ে তারপর শান্ত হলাম। এরপর বিছানায় গেলাম। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দীপু পাপা আমার পিছু পিছু আছেই। কখনো সে ঘাম মুছে দিচ্ছে। আবার কখনো সে আলাপের সুরে আমার সাথে কথা বলে যাচ্ছে। এরপরে ঘরের পরিবেশটা কিছু সময়ের মধ্যেই পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেল। আম্মু আমাকে আলুর চিপস ভেজে দিল। কয়েকটা খেয়েই- খুশিতে আমি সেগুলো দীপুকে নিজে হাতে খাইয়ে দিলাম। সে খেল। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। সেও হাসলো। এর কিছুক্ষণ পরেই দীপু পাপা আমাকে খুশি করতে দোকান থেকে আইসক্রিম নিয়ে এলো। আমি চাইলাম – দীপুও খাক। কিন্তু সে খেল না। বীনুকে দিল। বীনু কিছুটা খাওয়ার পরে তার কাছ থেকে আবার নিয়ে আমাকে খাওয়ালো বাকীটুকু। সবাই আমরা আবার স্বাভাবিক আনন্দে ফিরে গেলাম। বীনু শুয়ে শুয়ে টিভি দেখতে থাকলো। জয়ী পড়তে বসলো। দীপু গিয়ে বসলো কম্পিউটারে। আমি চুপচাপ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম।
কিন্তু এত কিছুর পরও কেউ বুঝতে পারছে না কিভাবে সিকোয়েন্সটা অনুসরণ করতে হবে। এর ভিতরে সবচে’ বেশী জটিলতা হয়েছে জয়ীকে নিয়ে। সে খুব ঘনঘন পোশাক পাল্টাতে থাকে। আমি তখন অসহায় বোধ করি। কী করবো বুঝতে পারি না। অথচ আমাদের সবার পোশাক পরার এই সিকোয়েন্সটা ঠিক রাখতে ক’দিন আগেই- কী যে ভয়ন্কর এক অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে- সেটা এর পরবর্তী পর্বে জানাবো। আরেকটি কথাও এখানে বলে রাখি- পোশাকের এই সিকোয়েন্স নিয়ে আমার ভাবনা দীর্ঘদিন চলবে। সেটা হতে পারে ছয় মাস কিংবা তারচে’ কম-বেশী কিছু কাল। এরপর আবার হয়তো নতুন কোন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাব। তখন ভুলেই যাব এই পোশাক বিষয়ক ভাবনার কথা। তাই এটা নিয়ে তোমাদের, অনেক টেনশনেরও কিছু নেই।

No comments:

Post a Comment