Thursday, December 21, 2017

৫ম পর্বঃ হাসির অন্তরালে (আত্মকথাঃ ফারহান আরিফ নাফি)

এক।।
লোকটা ঠিক আমার পিছনে পিছনে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। আমার থেকে দু’হাত সামনেই দীপু পাপা। লোকটার দিকে আমার মনোযোগ রয়েছে। সে আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন আমরা বেশ পরিচিত। অথচ মনে হচ্ছে তাকে আমি আগে কখনো দেখিনি। তার ঠোঁটের কোণায় হাসি। হতে পারে সে আমাকে চিনে। কিন্তু সে যে স্বস্তিতে নেই এবং সেটা আমার কারণে- সেটা বুঝেছি প্রথমবার তার দিকে তাকানোর পরই। অথচ সে কি-না হাসছে! তার অবস্থাটা দেখে আমার হঠাৎ হাসি পেল। তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। তার বোকা বোকা হাসিটা আরো বেড়ে গেল। তা দেখে আমার হাসিও বেড়ে গেল। আমি বেশ বুঝতে পারছি আমাকে দেখে সে “বিপদগ্রস্থ হাসি” হাসছে । এবার আমি শব্দ করে হাসতে শুরু করলাম। আমি হাসলেও বিল্ডিংটা গমগম করতে থাকে। সিঁড়িতে সেটা আরো বেশী হয়। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। হাসি পেলে আমি চট্ করে থামাতে পারি না। হাসতেই থাকি। দীপু একটুও না হেসে, শান্তভাবে লোকটাকে বললো – “ওর পিছনে পিছনে কেউ উঠছে, এটা ও পছন্দ করে না।” কথাটা ঠিক। দীপুর কথা শুনে লোকটা প্রায় থেমেই গেল। কিঞ্চিত ভয় মেশানো অস্বস্তিতে পড়ে গেল লোকটা এবার। মজার ব্যাপার হলো- তবু মুখটা সে জোর করে হাসি হাসি করে রেখেছে। তা দেখে আমার হাসি থামতে চাইছে না। আমি শব্দ করে হেসেই যাচ্ছি। ছয় তলা বিল্ডিং-এ আমাদের বাসাটা তিন তলায়। লোকটাকে খেয়াল করতে করতে দোতলা পর্যন্ত ওভাবেই উঠার পর হাসিটা একটু থামাতে চাইলাম। বারবার তবুও, বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত উপচে আসছে হাসির একেকটা ঢেউ। কোনরকমে নিজেকে সামলাতে সামলাতে- লোকটার আরো কাছ থেকে, তার চোখের ঠিক আরো গভীরে দেখার জন্যে, উপরে না উঠে- হঠাৎ তার দিকে যেতে শুরু করলাম। লোকটা প্রথমে থেমে গেল। এরপর একপা পিছিয়ে গেল। ভয় পেয়েছে! আমার হাসি চলে আসছে আবারো। এ’সময়ে হঠাৎ পিছন থেকে দীপু পাপা আমার হাত ধরে ফেললো- “আব্বু, কাম অন।” দীপুর কথা শুনে আমি নিজেকে সামলে আবারো উঠতে শুরু করলাম। কিন্তু হাসি থামাতে পারছি না। হা হা করে হাসতে হাসতে সিঁড়ি ভাঙছি। আমার শরীর বাঁকা হয়ে যাচ্ছে হাসির দমকে। ওভাবেই হাসতে হাসতেই বাসায় ঢুকলাম। বাসায় ঢোকার পরও আমার হাসি থামাতে পারছিলাম না অনেকক্ষণ পর্যন্ত। কিন্তু আমার হাসির এ’সময়ে, সবাই গম্ভীর হয়ে যার যার কাজ করছিল।
দুই।।
পেশাব পেলে আমার সাংঘাতিক হাসি পায়। হাসতে হাসতে আমার চোখ ফেটে পানি বেরুতে থাকে। সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে আমি হাসতে থাকি। ঘামতেও থাকি। কিন্তু এই হাসি থামানোর সাধ্যি তখন আমার থাকে না। এটা ঘটে আমার অনুভূতিগত জটিলতার কারণে। এ’সময়ে সবাই হয়তো যে যার মত কাজে ব্যস্ত। অথচ আমি হয়তো পড়ে গেছি তখন নিয়ন্ত্রণহীন এক কাতুকুতুর গর্তে। যে গর্তে পড়লে আমার হাসি আর থামাতে পারি না। আমার বীনু আম্মু অনেক ছোট বেলাতেই আমার এই সমস্যাটা ধরতে পেরেছিল। হাসতে হাসতে আমি অনেক সময়ে, তখন প্যান্টেই পেশাব করে দিতাম। এরপর থেকে আমি হাসলেই, সবাই বুঝতে চাইতো আমার পেশাব পেল কি-না। বাথরুমে গিয়ে আমি হাসতে হাসতে পেশাব করতে থাকি। তবে সবসময়েই যে পেশাব পেলেই হাসি পায় –এমনটা নয়। আমি বেশীরভাগ সময়েই স্বাভাবিক পেশাব করতে পারি। যদিও আমাকে রুটিনমাফিক এ’কাজটা করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু অনেক সময়েই পেশাব না- পেলেও, নিয়ন্ত্রণহীন হাসির কারণে- দীপু কিংবা বীনু আমার হাত ধরে জোর করে টানাটানি করতে থাকে আর বারবার বলতে থাকে- “নাফি বাথরুমে যাবে। পিসু করবে। আসো। কাম অন।” অথচ তখন হয়তো আমি হাসছি অন্য কোন কারণে। কিন্তু ভুল করে টানাটানি করলে, আমি হাসিটা কোনভাবে থামানোর জন্য যুদ্ধ করি নিজের সাথে। সেটা যতক্ষণ না-পারি ততক্ষণ আমাকে নিয়ে টানাটানি চলতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত আমি কোনরকমে কয়েক মুহুর্তের জন্য হাসি থামাতে পারি। তখন বুঝতে পেরে আমাকে যেই ছেড়ে দেয় অমনি আমার অনেক কষ্টে আটকে রাখা হাসি হুড়মুড় করে আবারও ছিটকে বেরিয়ে আসে। এভাবে অনেকটা সময় ধরে নিজের সাথে নিজেকেই যুদ্ধ করতে হয় এই হাসি থামানোর জন্যে। সামলাতে হয়- নিজেকেই নিজে।
তিন।।
অনেক ছোট ছোট আনন্দ-ও অনেক সময়ে, বেশী অনুভূত হয় আমার কাছে। যে আনন্দে একজন সাধারণ মানুষ মনে মনে শুধু মৃদু খুশিই হতে পারে, সেই একই আনন্দে আমি হয়তো বিশাল একটা লাফ দিয়ে, তীব্র চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করতে পারি এবং অনেকক্ষণ হাসতে পারি। অনেক সময়ে এমনটা ঘটে যে- কিছু একটা চাইতে গিয়ে কিংবা কাউকে কিছু একটা বোঝাতে গিয়ে আমি একটা জটিলতার ভিতরে পড়ে যাই। কিন্তু হঠাৎ যদি সেটা সহজেই মিটে যায়- তাহলেও কিছুক্ষণ হাসতে পারি। কিন্তু এটাও অনেক সময়ে ঘটে যায়- যে কাঁদতে যেয়ে হেসে ফেলেছি। যেটা শুধুই আমার প্রকাশ করার অক্ষমতা এবং অনুভূতিগত জটিলতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। আবার- সবার অলক্ষ্যে বিছানায় শুয়ে মাস্টারবেশন করার পর অদ্ভুত আনন্দদায়ক এবং তীব্র যে অনুভূতি আমার সমস্ত শরীর এবং অস্তিত্বে ছড়িয়ে পড়ে- তাতে আমি অনেক সময়েই হেসে ফেলি। সেটা কিন্তু নিঃশব্দ হাসি। আমার এমন নিঃশব্দ হাসি দেখে দীপু পাপা এগিয়ে আসে এবং আমার গোসলের ব্যবস্থা করে।
বাসায় রুটি বানাতে আসে যে মানুষটা বীনু এবং দীপু তাকে খালা বলে ডাকে। সেই বয়স্ক মানুষটা একটা ছন্দে কাজ করে। সে যখন এই রুটি বানানোর কাজটা শুরু করে আমি তার পাশে একটা টুলে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখতে থাকি। সে একটা সিকোয়েন্স অনুসরণ করে যখন কাজটা করে, তখন শেষের দিকে এসে অনেক আনন্দে আমি তার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসতে থাকি। কিন্তু সে হাসে না। আমি একা একাই হাসতে থাকি। আবার, এমন অনেক হাসির কারণ আছে যা দীপু পাপা কিংবা বীনু আম্মু এখনো জানে না- কেন হাসতে হাসতে আমার চোখে পানি চলে আসে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। (চলবে)

No comments:

Post a Comment