Thursday, December 21, 2017

৬ষ্ঠ পর্বঃ আমার চোখে নাফি (১)

এক।।
বৈশাখ প্রায় শেষ। আজ ৩০ তারিখ। গ্রীষ্মের দাবদাহ চলছে। আকাশের ছেঁড়া-ছেঁড়া ছাই-সাদা মেঘগুলোতে কোন আশার বারতা নেই। ঢাকার তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ঘরের ভিতরে বাতাসটাও গরম। উপরি হিসাবে আছে নিয়মিত লোড শেডিং। প্রচন্ড গরমে গত কয়েক রাতে ঘুম হয়নি কারো ঠিক মত। লোড শেডিং হলে আমার কাজ হলো- বিছানায় সবাইকে এক জা’গায় জড়ো করে- হাতপাখা চালিয়ে বাতাস করা। সেই সংগে, বিদ্যূৎ আসা পর্যন্ত, একটার পর একটা রবীন্দ্র সংগীত কিংবা দেশাত্মবোধক গান গাওয়া। নজরুল গীতিও মাঝে মাঝে কিছু হয়। জয়ীর পছন্দ ভূপেন। কিন্তু নাফি ধীর লয়ের গান পছন্দ করে। এটা ওকে শান্ত রাখে। আমার গানের তালে তালে নাফি ভীষনভাবে শরীর এবং মাথা দোলাতে থাকে। দুলতে দুলতেই সে আমার চোখ আর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এ’সময়ে, গানের সংগে- আমি প্রায় ৩ ঘন্টা বিরতিহীনভাবে হাত পাখা চালাতে পারি।
এটা ঠিক যে, প্রচন্ড গরম কিংবা ঠান্ডা- যে কারো জন্যেই সমস্যা। কিন্তু অনুভূতিগত স্পর্শকাতরতার কারণে নাফির সমস্যা অনেক গুণ বেশী। তার হাইপারনেস বেড়ে যায়। বিছানা, বালিশ আর জানালার পর্দা ছিঁড়ে পরিবেশের প্রতি অসহনীয়তা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে। ভয়ন্কর চিৎকার করতে-করতে নিজেকে আঘাত করে। আমি স্টেপ ওয়ান, টু, থ্রী, ফোর কৌশলগুলো একটার পর একটা প্রয়োগ করতে থাকি। কোনভাবে যদি কোনটায় তার কষ্ট লাঘব হয়- এই চেষ্টায়। ইদানিং তার হঠাৎ-করা দুম-দাম আঘাতগুলো নির্বিকার হজম করি। মনে হয়- এতে তার ভিতর থেকে বিষ কিংবা চাপ বেরিয়ে যায়। যাক না। আমিও তো তাই চাই। সেক্ষেত্রে, আমার পকেটে কৌশলের সংখ্যা বেড়ে হবে পাঁচ। সেটাও তো এক বিশাল পাওয়া।
দুই।।
বিকেল চারটা। নাফি আমার হাত ধরে নিয়ে গেল তার সেন্ডেল-স্যু’র কাছে। মানে- “আমাকে বাইরে নিয়ে চলো।” অথচ সে আগে কখনোই বাইরে যেতে চাইতো না। ইদানিং ২/৩ বার করে যাচ্ছে। মারাত্মক কোন সমস্যা না থাকলে, সব সময়েই ওর আবেদনে আমি সাড়া দেই। সেটা- দিন রাত ২৪ঘন্টার যে কোন সময়ে। কারণ- আমি তার key person. অটিষ্টিক বেবীদের জন্যে সংসারে একজনকে key person-এর ভূমিকা পালন করতে হয়। আমি তাকে সবচে’ বেশী সঙ্গ দিব এবং তার সব কথা যতটা সম্ভব- মানবো। অন্যরা ওর যে কথা মানতে চাইছে না, আমার মাধ্যমে, সে অন্যকেও তার সেই ইচ্ছাটা মানতে বাধ্য করতে পারে। বিনিময়ে নাফিও আমার কথা যতটা সম্ভব শুনবে। যেমন- ঠিক এই মুহুর্তে আমি যে ফুলহাতা জামাটা পরে আছি- সেটা আসলে শীতের পোশাক। কিন্তু আমার জ্বর হয়নি বা শীত করছে না। এটা আসলে- ওর সিকোয়েন্স সম্পর্কিত স্পর্শকাতর একটা বিষয়। জামাটার ডান হাতের কনুই এবং কোমরের একটু উপরে কিছুটা সেলাই ছুঁটে গিয়ে হা হয়ে গেছে। বাতিল যোগ্য হয়েছে বহু আগেই। জামাটা আমি গতকাল থেকে পরে আছি এবং ভেজাই পরতে হয়েছিল। কালো যে ট্রাউজারটা পরে আছি, সেটার সামনের দু’টো পকেটই ছেঁড়া। ফোন, কলম, টাকা, চাবি- সব পড়ে যায় সেখান থেকে। আসলে এটা মোটেও কোন সমস্যা নয়। আমার শখ, সমাজ কিংবা আরামের চাইতে ওর সিকোয়েন্স ঠিক রাখাটা অনেক বেশী জরুরী। সিকোয়েন্স ঠিক না থাকলে, ও হাইপার হবে। আর, হাইপার হলে, মুহুর্তের মধ্যে বাড়িটাকে সে নরক বানিয়ে ফেলবে। সবচে’ বড় কথা নিজেকে আঘাত করবে। ভয়ন্কর আঘাত। তাই, ছেঁড়া জামা-কাপড়ই সই। সে নিজেও সাদা যে টি-শার্টটা পরে আছে, সেটা মলিন এবং পেটের কাছে বেশ খানিকটা জায়গায় তরকারীর ঝোল লাগানো। তার পিঠ চুলকাতে হয় জামার উপর দিয়ে। সরাসরি ত্বকে- সে সহজে অন্যের ছোঁয়া নিতে পারে না। কিন্তু সে নিজেই যদি চুলকানোর কাজটা করে তাহলে তার চামড়া কিংবা জামার কিছু অংশ ‘নেই’ হয়ে যেতে পারে। সে’কারণে এই টি-শার্টের পিঠের দিকে দু’টো জায়গায় চোখে পড়ার মত বড় বড় ফুটো আছে। ওর পরনে কালো ট্রাউজার। সেটার ইলাস্টিকের টেম্পারমেন্ট হারিয়ে ঢিলা হয়ে গেছে বহু আগেই। ডান হাতে তার খেলার কার্ড থাকে বলে, বাম হাতে সে একটু পর পর ট্রাউজারটা টেনে বসিয়ে নিচ্ছে কোমরে। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই কোমর ছেড়ে আবার নেমে যাচ্ছে সেটা। অথচ আলমিরায় তার প্রচুর ভাল-ভাল জামা কাপড় রয়েছে। বিন্দু মাত্র আকর্ষণ নেই তার সে’সবের জন্যে। বাইরে হাঁটার সময়ে তার ট্রাউজারটা একটু পরপর টেনেটুনে কোমরে বসানোর কাজটা আমাকে করতে হয়। আর- কিছুক্ষণ পরপর গামছা দিয়ে তার ঘাম মুছতে থাকি। প্রচুর ঘামে সে।
আমাদের জামা কাপড়ের বেহাল এই দশা দেখে, এ’পাড়ায় কে কী ভাবছে- তাতে আমাদের কিছু এসে যায় না। এমন কি আপনারও খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু সত্যি বলছি- আমাদের একটুও খারাপ লাগছে না। আমরা বেশ সুখী মানুষ। গরম কালে শীতের পোশাক পরে দিব্যি গান গাইছি। হাসছি। এবং দিন পার করছি। যেহেতু আমি সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছি, তাই বৈরী কোন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর শক্তিও আমার বেশী। কিন্তু সমস্যাটা হয়েছে জয়ীকে নিয়ে। তার ভীষন মন খারাপ। ছোট্ট এই মানুষটা ঘুরে ফিরে এমন একেকটা মন খারাপ করা প্রশ্ন করতে থাকে যে-তার জন্যে মায়া হয়। সে প্রশ্ন করে- “দীপু, আমি কী আর কোন দিন আমার ইচ্ছে মত পোশাক পরতে পারবো না?” অথবা তার মায়ের কাছে জানতে চাইবে- “বীনু, আমি কী আমার ঈদের জামা পরতে পারবো না?” কিংবা হয়তো কাঁদো-কাঁদো হয়ে আমাকে বলবে- “তুমি ভাইয়াকে বলে দাও- আমি এখন থেকে আমার ইচ্ছে মত পোশাক পরবো।”
যে কারণে এত সমস্যা হয় তাহলো- সিকোয়েন্স অনুসরণ ছাড়াও, অটিষ্টিক মানুষরা পুরোনো জিনিষগুলোর প্রতি তীব্র অাকর্ষণ বোধ করে এবং তাদের নিত্য ব্যবহৃত জিনিষগুলোর সাথে সহজাতভাবেই একান্তের একটা সখ্যতা তৈরী করে। একই রং, সাইজ এবং ডিজাইনের ৩টি পোশাক আপনি কিংবা আমি হয়তো পার্থক্য নাও করতে পারি। কিন্তু নাফি পোশাক ৩টির মধ্যকার পার্থক্য খুব সহজেই ধরতে পারবে এবং মনে রাখতে পারবে। তাই কখন কোনটা পরছি বা পরবো সেটা চিনতে কিংবা নির্বাচনে- একটিবারেও তার বিন্দুমাত্র ভুল হবে না। এটা শুধুই প্রকৃতিপ্রদত্ত একটি বিশেষ শক্তি যা তার মধ্যে আছে। আর, পুরোনো জিনিসের প্রতি তীব্র এই আকর্ষণ- একটা অদ্ভূত illusion–ও বটে, যা অটিষ্টিক মানুষরা তীব্রভাবে অনুভব করে। ফলে, তার নিত্য ব্যবহৃত জিনিষপত্রগুলোকে রক্ষার জন্যে নিজেকে সে বিপদজনকভাবে আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে। সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রেও পুরোনো জিনিষের প্রতি এমন অনুভব কম-বেশী থাকে। সেই একই অনুভূতি সহজাতভাবে ওদেরও থাকে- কিন্তু অনেক বেশী মাত্রায়। যে কারণে, আমরা অনেক চেষ্টা করতে করতে, অনেক দেরীতে নাফিকে শীতকালের পোশাক শীতকালে পরাতে পারি। আবার শীত চলে গেলে, গরমের পোশাক পরার ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। এপ্রিল-মে’র প্রচন্ড গরমেও সে ঘামতে ঘামতে ব্লান্কেট ব্যবহার করতে থাকে। আর এ’সব কিছুই তাকে একটা নিরাপত্তা বোধ এনে দেয়।
তিন।।
বাইরের জগতটা তার কাছে ভীষণ রকমের বিশৃঙ্খল। সেখানে সে চরম অস্বস্তি এবং অনিরাপদ বোধ করে। ঘরের মত বাইরেও তার সাথে, তার খুব কাছের একজনকে থাকতে হয়। সে, বাসা থেকে সামান্য দূরেও, রাস্তায় হাঁটার সময়ে এতটাই ভয় পায় যে কাছের মানুষটাকে দু’হাতে শক্ত করে জাপটে ধরে। পাছে তাকে যদি ভুল করে ফেলে চলে যায়! কারণ সে জানে- সে কোনদিনই ঠিকমত রাস্তা চিনতে পারবে না। অপরিচিত কাউকে নিজের কথাটা বুঝিয়ে বলতে পারবে না। এবং এই পৃথিবীতে কেউ তাকে বুঝবে না। ফলে সে শিশুর মতই আতংকগ্রস্থ হয়ে তার সাথের মানুষটাকে শক্ত করে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে এবং অস্থিরভাবে চারদিকে তাকাতে তাকাতে- এলোমেলো পা ফেলে ছন্দহীনভাবে হাঁটতে থাকে। সে এতটাই জোরে জড়িয়ে ধরে যে তার দু’হাতের চাপে তখন ঠিকমত হাঁটাও দুরূহ হয়ে পড়ে। এটা সত্যি যে- রাস্তায় সে একা হয়ে পড়লে, কোনদিন সে আর বাড়ি ফিরতে পারবে না। এটা ওর জীবনের একটা মর্মান্তিক সত্য যা সে জানে এবং সে’কারণে আতংকিত বোধ করে। ৭/৮ বছর আগে শাহবাগের শিশু পার্কে নাফি একবার হারিয়ে গিয়েছিল। প্রায় সাথে সাথেই টের পাই আমরা। প্রথমেই এক দৌড়ে মেলার একমাত্র প্রবেশ পথে যেয়ে গেটম্যানদের সাবধান করি। সেখান থেকে দৌড়ে যেয়ে কন্ট্রোল রুমে জানাই। খুঁজতে খুঁজতে কিছুক্ষণ পর, সৌভাগ্যবশতঃ আমিই নাফিকে পেয়ে যাই।
নাফির চে’ ৫/৬ বছরের ছোট এক অটিষ্টিক ছেলে কোনভাবে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সে কোনভাবেই বাসায় ফিরতে পারছিল না। আর খারাপ ছেলেরা পাগল মনে করে তার জামা-কাপড় খুলে নিয়েছিল। নেংটো এবং অসহায়, ঠিক কতটা অসহায় আর আতংকিত হয়ে সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছিল- আমি সেটা কল্পনাও করতে পারি না। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে তার বাবা-মার কাছে পৌছে দেয় সেইদিনই। আমি ভীষণ আঘাত পেয়েছিলাম ঐ ঘটনা শোনার পর। আমি সেই ছেলেটার জায়গায় নাফিকে কল্পনা করি আর শিউরে উঠি। কোনদিন, কোনভাবে যদি নাফি হারিয়ে যায়… কেউই ওকে বুঝবে না। এ’দেশের যে সামাজিক চিত্র- তাতে ওকে পাগল ভেবে ভুল করবে সবাই। এবং সবাই ওরকম আচরণও করবে নাফির সংগে। …আমি আর ভাবতে পারি না। (চলবে)

No comments:

Post a Comment