Thursday, December 21, 2017

১ম পর্বঃ আমার চুলকাটা।। (আত্মকথাঃ ফারহান আরিফ নাফি)

লোকটাকে দেখেই চিনতে পারলাম। আমার চুল দাড়ি কাটতে এসেছে। খুবই খারাপ একটা সময় এটা। দীপু- মানে, আমার দীপু 
পাপা,সেই এই ছেলেটিকে বাসায় এনেছে। ছেলেটার নাম রাম। তার বয়স আমার চে’ একটু বেশী হতে পারে। রামের নিজের 
সেলুন আছে এই পাড়াতেই। তার সেলুনে প্রথমবার যখন চুল দাড়ি কাটতে যাই, অন্যদের মত সেও আমার দিকে অবাক হয়ে 
তাকিয়েছিল। রাম কথা খুব কম বলে। সে কোন কথা না-বলে চুল কাটতে শুরু করেছিল। তার সেলুনটা যথেষ্ট বড় নয়। 
বরং খুবই সংকীর্ণ জায়গায় দু’টো চেয়ার রেখে, কোন রকমে কাজ চালিয়ে নেয় রাম। ছাদটা একেবারে নিচু। আমি লম্বায় 
৫ফিট ৮ইঞ্চি। দাঁড়ানো অবস্থায় আমার মাথার সোজা- মাত্র ৯ইঞ্চি উপরেই, একটা তিন পাখাওয়ালা ফ্যান ঘুরছিল 
বিপদজ্জনকভাবে। চুল কাটা শুরু করেছিলাম তাই- অনেক অস্বস্তি নিয়ে। আর এই অস্বস্তির কারণেই আমার চুল কাটার 
সিকোয়েন্সগুলো দ্রুত শেষ করতে চাইছিলাম। আমার সমস্ত মনোযোগও তাই দ্রুত চুল কাটা শেষ করানোর দিকেই ছিল। আমাকে 
দেখে অবশ্য বোঝার কোন উপায় ছিল না- ভিতরে-ভিতরে কী তীব্র একটা অস্বস্তিতে আমি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। 
সিকোয়েন্সের ২য় অংশ হলো- আমার বগলের চুলগুলোকে কেটে ফেলে পরিস্কার করা। রাম বুঝতে পারছিল না আরো তাড়াতাড়ি 
সবকিছু শেষ করতে হবে। আমার ইন্দ্রিয়গত সংবেদনশীলতার কারণে, সাধারণ মানুষের চাইতে অনেক বেশী মাত্রায় তথ্য আমার
মস্তিষ্ক গ্রহন করে থাকে। যা বেশীর ভাগ সময়েই আমাকে স্বাভাবিক মানুষের মত চিন্তা এবং চলাফেরায় বাধাগ্রস্থ করে। 
এ’কারণেই আমার মনের অতিচেতনার অংশ বলছিল এটা খারাপ জায়গা। তাই আমাকে দ্রুত সবকিছু শেষ করে এখান থেকে 
বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সে’কথা আমি কাউকে বোঝানোর চেষ্টাও করতে পারি না। কারণ, কারো সাথে যোগাযোগ কিভাবে 
করতে হয়- আমি সেটা পারি না। জানি না- ঠিক কিভাবে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সাথে কথার মাধ্যমে যোগাযোগ 
স্থাপন করে। আমার একেকটা অনুভূতি অন্যান্য নানা ধরনের অনুভূতিগুলোর ভিতর দিয়ে ঠেলাঠেলি করে বেরিয়ে আসতে চায়। 
শেষে লাইনচ্যূত ট্রেনের মত অনুভূতিটা লাইনচ্যূত হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে অন্যান্য অনুভূতির সাথে এবং অবশেষে আমার কণ্ঠ 
থেকে বেরিয়ে অাসে ভিন্ন কোন শব্দ হয়ে- যার কোন অর্থ হয় না। কিন্তু আমি বোবাও নই! বোবা মানুষগুলো সাধারণতঃ 
বধির হয়ে থাকে। আমি বধির তো নই-ই, বরং সাধারণ মানুষদের তুলনায় আমার শ্রবণেন্দ্রিয় অনেক বেশী মাত্রায় সংবেদনশীল।
অনেক সূক্ষ্ণ শব্দও আমি শুনতে পাই। শব্দ শুনেই বুঝতে পারি- সারা বাড়িতে কোথায়, কে কী করছে। কিন্তু তীক্ষ্ণ শব্দ এবং 
উচ্চ শব্দ আমার কাছে ভীষণ পীড়াদায়ক অনুভূত হয়। এ’জন্যে আমাকে সারাক্ষণ দু’কানে অাঙ্গুল দিয়ে চলাফেরা করতে হয়। 
কিন্তু এ’সবের মানে এই নয় যে আমি কিছু বুঝি না। কিংবা একেবারে কিছুই বলতে পারি না, তাও নয়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই
আমার দৃষ্টিভঙ্গি সবার থেকে আলাদা। আমি হয় চুপ হয়ে থাকি অথবা আমার সেই অদ্ভূত-ভিন্ন শব্দগুলোকেই বারবার প্রকাশ 
করতে থাকি। এটা বেশী করি- যখন অাপন মনে থাকি। এবং এটা অনেকটা ঠিক নিজেকেই নিজে শোনানোর মত। তাই- 
আমি অন্যদের মত বোঝাতে পারি না- আমি কী ভাবছি। আমাকে অনেক যুদ্ধ করতে হয় নিজেকে বোঝানোর জন্যে।       
কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সেলুনের তখনকার মূহুর্তটা আমার কাছে তীব্র পীড়াদায়ক মনে হচ্ছিল। ভুলে গেলাম মাথার উপরে ঘুরতে 
থাকা ফ্যানের কথা। ফলে, চুল কাটা শেষ হওয়ার আগেই আমার বগল পরিস্কার করানোর জন্যে দুম করে উঠে দাড়িয়ে 
সিকোয়েন্সের ২য় অংশটাও শেষ করতে চাইলাম। কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই এবং কেউ আমাকে বাঁধা দেবার আগেই, 
যেই মাত্র আমি আমার ডান হাতটা উঁচু করেছি ঠিক তখনই ঘটে গেল দুর্ঘটনাটা। মাথার উপরে ঘুরতে থাকা ফ্যানে আমার 
হাতটা প্রচন্ড জোরে একটা বাড়ি খেল। সংগে সংগে বেশ জোরে একটা শব্দ হলো। চোখের পলকে একসাথে ঘটে গেল অনেক কিছু।
ফ্যানটা আমার হাতের ধাক্কায় একমূহুর্ত থেমে থেকে আবারও ঘুরতে শুরু করলো এবং সেই সংগে দোলনার মত দুলছেও। 
রাম ছেলেটা ভয়ের চোটে এক দৌড়ে সেলুনের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। তার চোখে মুখে আতংক। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। 
দীপু পাপা দ্রুত আমার হাতে কোথায় ব্যথা পেলাম এবং আমি কেমন বোধ করছি- আমার হাত আর মুখ দেখে সেটা বুঝতে
চেষ্টা করছে। না, কোন রক্ত বের হয়নি। আসলে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে আমার কোন ভাবান্তরও হয়নি আর। চুপচাপ 
প্রতিক্রিয়াহীন মানুষের মত বসে আছি। আমার মন তখন শান্ত-দীঘির পানির মত শান্ত। আসলে এ’ ধরনের আঘাতে অন্য যে
কোন সাধারণ মানুষের মত প্রতিক্রিয়া আমার হয় না। আমাকে নির্বিকার দেখে এবং রামের আতংকিত মুখ দেখে দীপু পাপা
হেসে ফেললো। সেটা কিন্তু তার কৃত্রিম হাসি ছিল! এরপর হাসিমুখে রামকে বললো- ‘আরে কিছুই তো হয়নি। তুমি ভয় পাচ্ছ 
কেন? ফ্যানের সাথে সামান্য একটা বাড়ি খেয়েছে শুধু- আর কিছু না। আসো, আসো।’ রাম এলো এবং ভয়ে ভয়ে সে কাজ 
শুরু করলো- যেখানে শেষ করেছিল, সেখান থেকে। ঐ সেলুনটাই ছিল এখন পর্যন্ত আমার শেষ সেলুন। আসলে এরপর থেকেই 
চুল কাটানোর জন্যে দীপু পাপা আমাকে নিয়ে আর কোথাও যায়নি। আজ আমার চুল কাটার দিন। তাই রামকেই বাসায় আনা 
হয়েছে। রাম যখন এলো তখন সময়টা প্রায় শেষ বিকেল। একটু পরেই ঝুপ করে বাইরে অন্ধকার নামবে। কাল দুপুর থেকে 
মোট তিনবার, আমার মানসিক প্রস্তুতির জন্যে দীপু পাপা আমাকে বুঝিয়েছে আজ আমার চুল কাটা হবে। ঐ ঘটনার পর থেকে 
গত কয়েক মাস যাবৎ আমার চুল কাটানোর কাজটা বাসায় করানো হচেছ।       
রামের সেলুনটা ছাড়াও আমাদের এই পাড়ায় আরো একটা সেলুন আছে। সেটা বেশ সুন্দর এবং বড়। কিন্তু সেটায় আমার চুল 
কাটতেই চায়নি। এবং প্রথমবারেই দেখেছিলাম- সেলুনের চুল কাটানোর লোকটা আমার দিকে বেশ তাচ্ছিল্য করেই তাকিয়েছিল। 
দীপু পাপা সেটা ঠিকই ধরতে পেরেছিল। দীপুর ভাবনাগুলো আমি বেশ বুঝতে পারি। তখন তার কী রাগ! রাগে গজ্ গজ্ 
করতে-করতে সেলুনের লোকটাকে বারবার ছাগল বলছিল। লোকটা অবশ্য সেটা শুনতে পাচ্ছিল না। আরেকটা সেলুন ছিল- 
বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। সেটাতেও আমার চুল কাটতে চাইতো না। সেই ছেলেটাও প্রায় আমার বয়সী ছিল। তার চোখ 
দেখেই বুঝতাম- সেও তাচ্ছিল্য করতো আমাকে। বিশেষ দয়ায় ২বার চুল কেটেছিল। তৃতীয়বার কোন কারণ ছাড়াই, 
আর কাটতো চাইলো না। ফিরিয়ে দিল আমাকে। দীপু পাপার মুখটা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম- সে তীব্র রাগ আর অপমান 
বোধ করেছিল। এবং আমার তখন মনে হয়েছিল পাপা যে কোন খারাপ কিছু করে ফেলতে পারে। আবার ভাল একটা সমাধানও 
করে ফেলতে পারে। যেটা ভাল হবে ঠিক আমার জন্যে। সে অবশ্য ভালটাই করে বেশির ভাগ সময়ে। কিন্তু খুব খারাপ 
দেখাচিছল দীপু পাপার মুখটা সেদিন। এর কিছুদিন পর সেই সেলুনটা বন্ধ হয়ে যায়। লুকাসের মোড়ের সেলুনটাও আমার 
অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে দ্বিগুন টাকা চেয়েছিল। অথচ অন্যদের চে’ আমার চুল কাটানোয় ঝামেলা অনেক কম ছিল। 
আমি আমার স্পর্শকাতর ত্বকের কারণে গায়ে কোন কাপড়, যার উপরে কাটা-চুল পড়বে, তেমন কিছু জড়াতে পারি না। 
কারণ আমার শরীরে শুধু মাত্র বিশেষ ধরনের নরম কাপড়(knit fabric) ছাড়া অন্য কোন ধরনের কাপড়ের স্পর্শ নিতে 
পারি না। ফলে, খালি গায়ে চেয়ারে শুধু বসে পড়লেই হলো। আমার চুল ছাটা, বগল পরিস্কার এবং শেভ- এই তিনটি কাজ 
অনেক কম ঝামেলায় এবং কম সময়ে শেষ হয়ে যায়। তবু তারা অনেক বেশী দাবী করেছিল- আমাকে তাদের বিশেষ দয়ায় 
চুল কেটেছিল বলে। দীপু সেটা দেয়নি এবং রাগের চোটে ওদের ওখানে আমাকে নেয়া বন্ধ করে দিলো। আমাদের গলির এই 
বড় সেলুনটা আমাকে তাচ্ছিল্য করে ফিরিয়ে দিলেও, আমি জানি- দীপু এবার নাছোড় বান্দার মত লোকটাকে নিয়ে ভাবতে 
থাকবে। ভেবে একটা সমাধান ঠিকই বের করে ফেলবে। ইতমধ্যে আমার চুল-দাড়ি বিশ্রী রকমের বড় হয়ে গেছে। সারাদিনই 
খুব অস্বস্তি বোধ হয় সে’ জন্যে। এর বেশ কিছুদিন পরে, প্রথমবারের মত, পাড়ার নতুন বড় সেলুনটায় চুল কাটতে 
পেরেছিলাম। রাগ আর অপমান চেপে রেখে খাতির জমাতে গিয়ে দীপু অনেক কথা বললো তাদের সাথে। আলাপের সুরে সে 
আমার সম্পর্কে চুল কাটানোওয়ালা লোকটাকে ধারনা দিতে থাকলো- অটিজম কী, পৃথিবীতে কতজন বিজ্ঞানী অটিজমে আক্রান্ত 
ছিলেন, তারপরে কাটা-পড়া চুলের ছোট ছোট টুকরোর খোঁচা আমার ঘাড়ে কেমন অনুভূতি তৈরী করে, অটিজম নিয়ে সরকার 
কী কী করছে- এইসব অনবরত বলতে থাকে। আমার মোটেও ভাল লাগেনা দীপু পাপা যখন ওদেরকে এইসব কথা বলতে থাকে। 
কারণ ওরা এসব বোঝে না। কিন্তু বোঝার ভান করে। আমি এই সময়ে চুপচাপ এবং তাড়াতাড়ি সব কিছু শেষ করে বাসায় 
ফিরতে চাই। খারাপ লাগার যেটা হলো- তাহলো দীপু পাপা যে এত কষ্ট করে ওদের সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করলো তাতে 
কোন লাভ হলো না। আমি বেশ বুঝতে পারছি দীপু পাপাকে ওরা বোকা একজন মানুষ মনে করেছে। ওদের ভুল হয়েছে। 
দীপু পাপা দেখতে খুব সাধারণ হলেও অনেক অন্যরকম তার চিন্তা-ভাবনার জগত। তো, দীপু পাপাকে ওরা সাধারণ আর বোকা 
মানুষ ভেবেই দেড়গুণ টাকা বেশী চেয়ে ফেললো! কিন্তু দীপু পাপা যে সেটা দিবে না- আমি জানতাম। কারণটা মোটেই অক্ষমতা 
নয়। বরং কারণটা এটাই যে ওরা আমার সাথে অন্যায় করছে। তাই দেড়গুণ বেশী টাকা যে দীপু দিবে না- সেটা বুঝতে 
পেরেছিলাম। ঐ পরিমাণ টাকা দীপু দেয়নি বলে বড় ছেলেটা আমাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে ছোট ছেলেটাকে নির্দেশ দিল- 
‘তুই আর হের চুল কাটবি না। আইজকেই শ্যাষ’। মজার ব্যাপার হলো- আমাকে আর আমার পাপাকে ওরা বোকা ভেবেছে। 
আসলে কিন্তু ওদের বুদ্ধি এত কম যে- আমরা, মানে আমি আর আমার পাপা কে কী ভেবেছিলাম- ওরা সেটা একটুও বুঝতে 
পারেনি। আমরা কিন্তু ঠিকই বুঝেছিলাম- ওরা কে কী ভেবেছিল সে’দিন। এটাকে বলে সেন্স অব এমপ্যাথি (sense of 
empathy)। মানে অন্যকে বোঝার ক্ষমতা। অন্যের অনুভূতি ধরতে পারা। যা ওদের নেই। কিন্তু জন্মগতভাবেই এটা আমার 
ভেতরে আছে অনেক বেশী মাত্রায়। (চলবে)

No comments:

Post a Comment