Thursday, December 21, 2017

৭ম পর্বঃ আমার চোখে নাফি- (২)

পানি আর বিদ্যূতবিহীন জ্যৈষ্ঠ্যের খর-তাপে পোড়া দুপুরটাকে আজ অন্যরকম লাগে। অন্য দশটা দিনের সাথে কোন মিল নেই। ঢাকার তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বাতাস বইছে না। গাছগুলো পাতা কাঁধে নিয়ে বিমর্ষ দাঁড়িয়ে- তাপদগ্ধ, প্রাণ করতলে। আমাদের মতই। এলাকায় বিদ্যূৎ নেই সকাল থেকে। বিদ্যূৎবিহীন সকালগুলোকে ঠিক লবনবিহীন পান্তার মত পানসে লাগে! শুধু চুপচাপ গিলে যাও! তার উপরে গতকাল থেকে পানি নেই এই ফ্ল্যাটে। প্রথম কারণ- ট্যাংকি পরিস্কার করতে হবে। সেটা প্রায় সারাদিনের কাজ। অথচ বাড়িওয়ালা কাউকে সেই মেসেজটা পর্যন্ত দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। আমাদের যেটা হলো- হঠাৎ ভয়ন্কর ময়লা পানি আসতে শুরু করার পর আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। ড্রামে যে পানিটুকু ছিল তাও নষ্ট হয়ে গেল। দ্বিতীয় কারণ- সারাদিন ধরে ট্যাংকি পরিস্কার করে, রাতে পানি দিতে গিয়ে- পানির মটরটাই জ্বলে গেল। কখন ঠিক হবে- কেউ জানে না। ঘরের ভিতরে আঁটকে থাকা গরম-গুমোট বাতাসটার ওজন বেড়ে গেছে মনে হয়। হাতপাখা চালিয়ে বাতাস করে যাচ্ছি নাফিকে। সেই সংগে নিয়ম মাফিক নাফির জন্যে গানও গাইছি। কিন্তু ভাল বোধ করছি না বলে, অনেকটা আবেগহীনভাবে দু’টো গানই বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গাইছি– “কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া” এবং “চোখের আলোয় দেখেছিলাম চোখের বাহিরে।” মাঝে মাঝেই গানের লাইনও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। লাইন ভুল হলে সাথে সাথে নাফির দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি- তার কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি-না! আমাদের চার চোখের মিলন হলে, আমি ওকে হাসি উপহার দিচ্ছি। কিন্তু আমার হাসির প্রত্যুত্তরে সে প্রতিক্রিয়াহীন। গম্ভীর।
ওর গায়ের জামাটা ঘামে ভিজে সপসপে হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা খুলতে দিতে রাজী নয় সে কোনভাবেই। পাখার বাতাসটা ওর ঠান্ডা লাগার কথা। সে চুপচাপ। শুয়ে শুয়েই হাতের কার্ডগুলো নিয়ে আপন মনে খেলছে। সমস্ত মনোযোগ দু’হাতের আংগুলে ধরা কার্ডের দিকে। তার মাথা এবং পিঠের নিচে বালিশ-বিছানা ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই সে উঠে বসে খেলতে খেলতে অনবরত শরীর দোলাচ্ছে। অটিস্টিকদের বেলায় ক্রমাগত হাত বা পা নাড়ানো, একা একা নিজে নিজে নড়তে থাকা বা শরীর দোলানো, একা একা এক জায়গায় ঘুরতে থাকা, নিজের শরীরকে নিজে চেপে ধরা বা কোন নির্দিষ্ট শব্দ বা কয়েকটি শব্দ ক্রমাগত বলতে থাকা –এ’সব খুব common দৃশ্য। এ আচরণগুলোকে stimming বলা হয়। Stimming বলতে সহজ ভাষায় Self-stimulatory behavior বা আচরণকে বোঝায়, যাকে অনেক সময় stereo-type আচরণও বলা হয়।
আমি ঘামছি খালি গায়ে। কালো শরীরটা ভেজা, চকচকে। কল-কল করে ঘাম নেমে যাচ্ছে কোমরে। সেখানে জিনসের ট্রাউজারটা ঘাম শুষে নিতে-নিতে গাঢ় নীল হয়ে গেছে। বারান্দায় এসে উঁকি দিয়ে দেখছি জয়ীকে দেখা যায় কি-না। মায়ের সাথে সে গোসল করতে নানু বাড়িতে গেছে। নাহ্, দেখা নেই ওদের। ফোন দিতেই সেটা রিসিভ করলো জয়ী। জিজ্ঞেস করলাম- আর কতক্ষণ লাগতে পারে? মিষ্টি করে বললো “ আম্মু বাথরুমে। আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবো। কেন তোমার ক্ষুধা লেগেছে, দীপু?” কী বলবো- খুঁজে না-পেয়ে বললাম- “না তো, মা। ক্ষুধা লাগেনি। সব ঠিক আছে। তোমরা এসো। ঠিক আছে- আমি রাখছি।” জয়ী এবং তার মা এলো আধাঘন্টা বাদে। প্রায় সাথে সাথে বিদ্যূৎ এবং পানিও এলো! আমিও সিকোয়েন্স অনুযায়ী আমার ছেঁড়া টি-শার্টটা পরে নিলাম। গুটিয়ে রাখা জানালার ভারী পর্দা ফেলে দিয়ে ঘর অন্ধকার করে দিলাম। কিন্তু অনেক যন্ত্রনার পর পাওয়া সব আনন্দ ছিঁড়ে-ফুঁড়ে জয়ী ঘোষনা দিল- সে আর তার ভাইয়ার পছন্দে জামা-কাপড় পরবে না। কোনভাবেই না। ফলে সে বেছে নিল- একটা নীল টি-শার্ট। সাথে কালো রংয়ের ট্রাউজার। ওকে আমি সমর্থন করতে পারছি না কারণ, নাফি রিয়েক্ট করতে পারে- এটা ভেবে। আবার মনে হলো- ঠিক আছে। পরুক না কিছুক্ষণ। নাফির থেকে একটু চোখের আড়ালে থাকলেই তো হলো! ছোট্ট মানুষটা আর কতক্ষণ সব মেনে নিয়ে চলবে? নাফি চাইলে আবার না হয় পরবে- কিংবা তখন দেখা যাবে! আমি সায় দিলাম- “ঠিক আছে মা পরো। কিন্তু তুমি ঐ রুমে যেও না। এদিকে থাক।” তার তাৎক্ষণিক উত্তর- “কেন যাব না। আমি কি বাইরের মানুষ? তুমি ভাইয়াকে বলে দাও, আমি আমার পছন্দমত জামা কাপড় পরবো।” আমার কন্ঠে ভয় এবং বিরক্তি- “আহ্-হা, জয়ী! তুমি বোঝ না। আমি তোমাকে যেটা বললাম- তুমি সে’ভাবে চলবে। একদম বুঝতে পারছো না তুমি- তোমার ভাইয়া দেখলে কী হতে পারে!”
জয়ী তার পছন্দের জামা-কাপড় পরার পর থেকেই আমার সমস্ত মনোযোগ দু’জনের উপরেই পালা করে ঘুরছে। কিন্তু শেষ রক্ষাটা হলো না। নাফির চোখে জয়ী ধরা পড়ার সাথে সাথে সে উঠে দাঁড়ালো। ওর পরবর্তী প্রতিটা ধাপ আমার মুখস্ত। আমি জানি- ও এখন কী কী করবে। আমি দ্রুত চলে গেলাম ওর কাছে। ততক্ষণে নাফি ছুটে গিয়ে জয়ীর খুলে ফেলা জামা কাপড় গুলো হাতে নিয়ে, আপাত-দৃষ্টিতে শান্তভাবেই শুধু জয়ীর দিকে হাত বাড়িয়ে ধরে আছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি- নাফি আসলে breaking point-এর কাছাকাছি চলে এসেছে। দূর্ভাগ্য আমার, সেটা আমি ছাড়া আর কেউ ধরতে পারে না। কারণ- বাইরে থেকে ওকে একদম শান্ত দেখায় এ’সময়ে। কিন্তু ভিতরের মানুষটা এখন বিস্ফোরণ উন্মুখ একটা টাইম বোমার মতই! শুধু জয়ী প্রকাশ্যে আপত্তি জানালেই বিস্ফোরণটা ঘটে যাবে। আমি দ্রুত ওর হাত থেকে জয়ীর কাপড়গুলো নিয়ে কৃত্রিম আদেশের মত করে বললাম- “জয়ী যাও, এ’গুলো পরে এসো।” নাফি আমার পিছনেই দাঁড়ানো। সে মাইন্ড রিডিং ভালই জানে। তাই সে স্পষ্ট পড়তে পারছে জয়ীকে। আমার ভিতরে চেপে রাখা টেনশন আর অবচেতনে যুদ্ধের প্রস্তুতি! ঠিক জয়ী যে মূহুর্তে বিরক্তি প্রকাশ করে নাফির দেয়া পোশাক পরতে আপত্তি জানালো- আমার পিছনে মনে হলো বোমা ফাটলো। আতকিংত হওয়ার মতই ভয়ন্কর এক চিৎকার দিয়ে বিস্ফোরণটা ঘটিয়ে দিল নাফি। শুরু হলো সে’দিনের যুদ্ধ। প্রথম আক্রমণটা আমাকেই করলো। এরপর আমাকে ছেড়ে প্রচন্ড জোরে-জোরে থাপ্পড় মারতে শুরু করলো- নিজের কান, মাথা আর গাল জুড়ে। প্রায় ঘন্টা তিনেকের যুদ্ধের পরে আবিষ্কার করলাম- নাফির গালটা ফুলে গেছে ওর ক্রমাগত স্বঘাতের ফলে। জয়ী, ভাইয়ার দেয়া সেই জামা-কাপড় পরে, ভয়ে গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে বিছানার কোণায়- দেয়াল ঘেঁষে। আমার ছেঁড়া টি-শার্টটা নতুন করে আরো দু’জায়গায় ছিঁড়েছে। বীনা ক্লান্ত শরীরে বারবার রান্নাঘরে যাচ্ছে আসছে আর একটু পর পর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে- উফ্ শব্দে। কিন্তু আমি সে’দিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক আবিস্কার করে দারুণ হালকা বোধ করছি ভবিষ্যতের যুদ্ধের কথা ভেবে। সেটা হলো- ওর হাত দু’টোকে বেঁধে নিয়ে ল্যাং মেরে ওকে বিছানায় শুইয়ে ভাল করে ঠান্ডা পানি দিয়ে শান্ত না-হওয়াবধি মুছতে থাকা। ঠেসে ধরে নিয়ন্ত্রণের কৌশলটা অনেকেই প্রয়োগ করে। আর আমি সেটা শিখেছিলাম ইউটিউব থেকে। সেটার সাথে প্রচুর শক্তির অপচয় ঘটে। কিন্তু আমার সদ্য আবিস্কৃত এই কৌশলটা অনেক ভাল কাজ করেছে। আসলে যে পরিবারে একটা অটিষ্টিক সন্তান থাকে সে পরিবারে প্রায় প্রতিটি দিনই হয় যুদ্ধের। আর আমাদের পুরো জীবনটাই তাই যুদ্ধের কাল! কিন্তু বারবারই হেরে যাই নিজের কাছে যখন ভাবি- আমার এবং বীনার মৃত্যুর পরে- নাফির কী হবে! (চলবে)

৬ষ্ঠ পর্বঃ আমার চোখে নাফি (১)

এক।।
বৈশাখ প্রায় শেষ। আজ ৩০ তারিখ। গ্রীষ্মের দাবদাহ চলছে। আকাশের ছেঁড়া-ছেঁড়া ছাই-সাদা মেঘগুলোতে কোন আশার বারতা নেই। ঢাকার তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ঘরের ভিতরে বাতাসটাও গরম। উপরি হিসাবে আছে নিয়মিত লোড শেডিং। প্রচন্ড গরমে গত কয়েক রাতে ঘুম হয়নি কারো ঠিক মত। লোড শেডিং হলে আমার কাজ হলো- বিছানায় সবাইকে এক জা’গায় জড়ো করে- হাতপাখা চালিয়ে বাতাস করা। সেই সংগে, বিদ্যূৎ আসা পর্যন্ত, একটার পর একটা রবীন্দ্র সংগীত কিংবা দেশাত্মবোধক গান গাওয়া। নজরুল গীতিও মাঝে মাঝে কিছু হয়। জয়ীর পছন্দ ভূপেন। কিন্তু নাফি ধীর লয়ের গান পছন্দ করে। এটা ওকে শান্ত রাখে। আমার গানের তালে তালে নাফি ভীষনভাবে শরীর এবং মাথা দোলাতে থাকে। দুলতে দুলতেই সে আমার চোখ আর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এ’সময়ে, গানের সংগে- আমি প্রায় ৩ ঘন্টা বিরতিহীনভাবে হাত পাখা চালাতে পারি।
এটা ঠিক যে, প্রচন্ড গরম কিংবা ঠান্ডা- যে কারো জন্যেই সমস্যা। কিন্তু অনুভূতিগত স্পর্শকাতরতার কারণে নাফির সমস্যা অনেক গুণ বেশী। তার হাইপারনেস বেড়ে যায়। বিছানা, বালিশ আর জানালার পর্দা ছিঁড়ে পরিবেশের প্রতি অসহনীয়তা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে। ভয়ন্কর চিৎকার করতে-করতে নিজেকে আঘাত করে। আমি স্টেপ ওয়ান, টু, থ্রী, ফোর কৌশলগুলো একটার পর একটা প্রয়োগ করতে থাকি। কোনভাবে যদি কোনটায় তার কষ্ট লাঘব হয়- এই চেষ্টায়। ইদানিং তার হঠাৎ-করা দুম-দাম আঘাতগুলো নির্বিকার হজম করি। মনে হয়- এতে তার ভিতর থেকে বিষ কিংবা চাপ বেরিয়ে যায়। যাক না। আমিও তো তাই চাই। সেক্ষেত্রে, আমার পকেটে কৌশলের সংখ্যা বেড়ে হবে পাঁচ। সেটাও তো এক বিশাল পাওয়া।
দুই।।
বিকেল চারটা। নাফি আমার হাত ধরে নিয়ে গেল তার সেন্ডেল-স্যু’র কাছে। মানে- “আমাকে বাইরে নিয়ে চলো।” অথচ সে আগে কখনোই বাইরে যেতে চাইতো না। ইদানিং ২/৩ বার করে যাচ্ছে। মারাত্মক কোন সমস্যা না থাকলে, সব সময়েই ওর আবেদনে আমি সাড়া দেই। সেটা- দিন রাত ২৪ঘন্টার যে কোন সময়ে। কারণ- আমি তার key person. অটিষ্টিক বেবীদের জন্যে সংসারে একজনকে key person-এর ভূমিকা পালন করতে হয়। আমি তাকে সবচে’ বেশী সঙ্গ দিব এবং তার সব কথা যতটা সম্ভব- মানবো। অন্যরা ওর যে কথা মানতে চাইছে না, আমার মাধ্যমে, সে অন্যকেও তার সেই ইচ্ছাটা মানতে বাধ্য করতে পারে। বিনিময়ে নাফিও আমার কথা যতটা সম্ভব শুনবে। যেমন- ঠিক এই মুহুর্তে আমি যে ফুলহাতা জামাটা পরে আছি- সেটা আসলে শীতের পোশাক। কিন্তু আমার জ্বর হয়নি বা শীত করছে না। এটা আসলে- ওর সিকোয়েন্স সম্পর্কিত স্পর্শকাতর একটা বিষয়। জামাটার ডান হাতের কনুই এবং কোমরের একটু উপরে কিছুটা সেলাই ছুঁটে গিয়ে হা হয়ে গেছে। বাতিল যোগ্য হয়েছে বহু আগেই। জামাটা আমি গতকাল থেকে পরে আছি এবং ভেজাই পরতে হয়েছিল। কালো যে ট্রাউজারটা পরে আছি, সেটার সামনের দু’টো পকেটই ছেঁড়া। ফোন, কলম, টাকা, চাবি- সব পড়ে যায় সেখান থেকে। আসলে এটা মোটেও কোন সমস্যা নয়। আমার শখ, সমাজ কিংবা আরামের চাইতে ওর সিকোয়েন্স ঠিক রাখাটা অনেক বেশী জরুরী। সিকোয়েন্স ঠিক না থাকলে, ও হাইপার হবে। আর, হাইপার হলে, মুহুর্তের মধ্যে বাড়িটাকে সে নরক বানিয়ে ফেলবে। সবচে’ বড় কথা নিজেকে আঘাত করবে। ভয়ন্কর আঘাত। তাই, ছেঁড়া জামা-কাপড়ই সই। সে নিজেও সাদা যে টি-শার্টটা পরে আছে, সেটা মলিন এবং পেটের কাছে বেশ খানিকটা জায়গায় তরকারীর ঝোল লাগানো। তার পিঠ চুলকাতে হয় জামার উপর দিয়ে। সরাসরি ত্বকে- সে সহজে অন্যের ছোঁয়া নিতে পারে না। কিন্তু সে নিজেই যদি চুলকানোর কাজটা করে তাহলে তার চামড়া কিংবা জামার কিছু অংশ ‘নেই’ হয়ে যেতে পারে। সে’কারণে এই টি-শার্টের পিঠের দিকে দু’টো জায়গায় চোখে পড়ার মত বড় বড় ফুটো আছে। ওর পরনে কালো ট্রাউজার। সেটার ইলাস্টিকের টেম্পারমেন্ট হারিয়ে ঢিলা হয়ে গেছে বহু আগেই। ডান হাতে তার খেলার কার্ড থাকে বলে, বাম হাতে সে একটু পর পর ট্রাউজারটা টেনে বসিয়ে নিচ্ছে কোমরে। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই কোমর ছেড়ে আবার নেমে যাচ্ছে সেটা। অথচ আলমিরায় তার প্রচুর ভাল-ভাল জামা কাপড় রয়েছে। বিন্দু মাত্র আকর্ষণ নেই তার সে’সবের জন্যে। বাইরে হাঁটার সময়ে তার ট্রাউজারটা একটু পরপর টেনেটুনে কোমরে বসানোর কাজটা আমাকে করতে হয়। আর- কিছুক্ষণ পরপর গামছা দিয়ে তার ঘাম মুছতে থাকি। প্রচুর ঘামে সে।
আমাদের জামা কাপড়ের বেহাল এই দশা দেখে, এ’পাড়ায় কে কী ভাবছে- তাতে আমাদের কিছু এসে যায় না। এমন কি আপনারও খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু সত্যি বলছি- আমাদের একটুও খারাপ লাগছে না। আমরা বেশ সুখী মানুষ। গরম কালে শীতের পোশাক পরে দিব্যি গান গাইছি। হাসছি। এবং দিন পার করছি। যেহেতু আমি সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছি, তাই বৈরী কোন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর শক্তিও আমার বেশী। কিন্তু সমস্যাটা হয়েছে জয়ীকে নিয়ে। তার ভীষন মন খারাপ। ছোট্ট এই মানুষটা ঘুরে ফিরে এমন একেকটা মন খারাপ করা প্রশ্ন করতে থাকে যে-তার জন্যে মায়া হয়। সে প্রশ্ন করে- “দীপু, আমি কী আর কোন দিন আমার ইচ্ছে মত পোশাক পরতে পারবো না?” অথবা তার মায়ের কাছে জানতে চাইবে- “বীনু, আমি কী আমার ঈদের জামা পরতে পারবো না?” কিংবা হয়তো কাঁদো-কাঁদো হয়ে আমাকে বলবে- “তুমি ভাইয়াকে বলে দাও- আমি এখন থেকে আমার ইচ্ছে মত পোশাক পরবো।”
যে কারণে এত সমস্যা হয় তাহলো- সিকোয়েন্স অনুসরণ ছাড়াও, অটিষ্টিক মানুষরা পুরোনো জিনিষগুলোর প্রতি তীব্র অাকর্ষণ বোধ করে এবং তাদের নিত্য ব্যবহৃত জিনিষগুলোর সাথে সহজাতভাবেই একান্তের একটা সখ্যতা তৈরী করে। একই রং, সাইজ এবং ডিজাইনের ৩টি পোশাক আপনি কিংবা আমি হয়তো পার্থক্য নাও করতে পারি। কিন্তু নাফি পোশাক ৩টির মধ্যকার পার্থক্য খুব সহজেই ধরতে পারবে এবং মনে রাখতে পারবে। তাই কখন কোনটা পরছি বা পরবো সেটা চিনতে কিংবা নির্বাচনে- একটিবারেও তার বিন্দুমাত্র ভুল হবে না। এটা শুধুই প্রকৃতিপ্রদত্ত একটি বিশেষ শক্তি যা তার মধ্যে আছে। আর, পুরোনো জিনিসের প্রতি তীব্র এই আকর্ষণ- একটা অদ্ভূত illusion–ও বটে, যা অটিষ্টিক মানুষরা তীব্রভাবে অনুভব করে। ফলে, তার নিত্য ব্যবহৃত জিনিষপত্রগুলোকে রক্ষার জন্যে নিজেকে সে বিপদজনকভাবে আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে। সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রেও পুরোনো জিনিষের প্রতি এমন অনুভব কম-বেশী থাকে। সেই একই অনুভূতি সহজাতভাবে ওদেরও থাকে- কিন্তু অনেক বেশী মাত্রায়। যে কারণে, আমরা অনেক চেষ্টা করতে করতে, অনেক দেরীতে নাফিকে শীতকালের পোশাক শীতকালে পরাতে পারি। আবার শীত চলে গেলে, গরমের পোশাক পরার ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। এপ্রিল-মে’র প্রচন্ড গরমেও সে ঘামতে ঘামতে ব্লান্কেট ব্যবহার করতে থাকে। আর এ’সব কিছুই তাকে একটা নিরাপত্তা বোধ এনে দেয়।
তিন।।
বাইরের জগতটা তার কাছে ভীষণ রকমের বিশৃঙ্খল। সেখানে সে চরম অস্বস্তি এবং অনিরাপদ বোধ করে। ঘরের মত বাইরেও তার সাথে, তার খুব কাছের একজনকে থাকতে হয়। সে, বাসা থেকে সামান্য দূরেও, রাস্তায় হাঁটার সময়ে এতটাই ভয় পায় যে কাছের মানুষটাকে দু’হাতে শক্ত করে জাপটে ধরে। পাছে তাকে যদি ভুল করে ফেলে চলে যায়! কারণ সে জানে- সে কোনদিনই ঠিকমত রাস্তা চিনতে পারবে না। অপরিচিত কাউকে নিজের কথাটা বুঝিয়ে বলতে পারবে না। এবং এই পৃথিবীতে কেউ তাকে বুঝবে না। ফলে সে শিশুর মতই আতংকগ্রস্থ হয়ে তার সাথের মানুষটাকে শক্ত করে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে এবং অস্থিরভাবে চারদিকে তাকাতে তাকাতে- এলোমেলো পা ফেলে ছন্দহীনভাবে হাঁটতে থাকে। সে এতটাই জোরে জড়িয়ে ধরে যে তার দু’হাতের চাপে তখন ঠিকমত হাঁটাও দুরূহ হয়ে পড়ে। এটা সত্যি যে- রাস্তায় সে একা হয়ে পড়লে, কোনদিন সে আর বাড়ি ফিরতে পারবে না। এটা ওর জীবনের একটা মর্মান্তিক সত্য যা সে জানে এবং সে’কারণে আতংকিত বোধ করে। ৭/৮ বছর আগে শাহবাগের শিশু পার্কে নাফি একবার হারিয়ে গিয়েছিল। প্রায় সাথে সাথেই টের পাই আমরা। প্রথমেই এক দৌড়ে মেলার একমাত্র প্রবেশ পথে যেয়ে গেটম্যানদের সাবধান করি। সেখান থেকে দৌড়ে যেয়ে কন্ট্রোল রুমে জানাই। খুঁজতে খুঁজতে কিছুক্ষণ পর, সৌভাগ্যবশতঃ আমিই নাফিকে পেয়ে যাই।
নাফির চে’ ৫/৬ বছরের ছোট এক অটিষ্টিক ছেলে কোনভাবে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সে কোনভাবেই বাসায় ফিরতে পারছিল না। আর খারাপ ছেলেরা পাগল মনে করে তার জামা-কাপড় খুলে নিয়েছিল। নেংটো এবং অসহায়, ঠিক কতটা অসহায় আর আতংকিত হয়ে সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছিল- আমি সেটা কল্পনাও করতে পারি না। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে তার বাবা-মার কাছে পৌছে দেয় সেইদিনই। আমি ভীষণ আঘাত পেয়েছিলাম ঐ ঘটনা শোনার পর। আমি সেই ছেলেটার জায়গায় নাফিকে কল্পনা করি আর শিউরে উঠি। কোনদিন, কোনভাবে যদি নাফি হারিয়ে যায়… কেউই ওকে বুঝবে না। এ’দেশের যে সামাজিক চিত্র- তাতে ওকে পাগল ভেবে ভুল করবে সবাই। এবং সবাই ওরকম আচরণও করবে নাফির সংগে। …আমি আর ভাবতে পারি না। (চলবে)

৫ম পর্বঃ হাসির অন্তরালে (আত্মকথাঃ ফারহান আরিফ নাফি)

এক।।
লোকটা ঠিক আমার পিছনে পিছনে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। আমার থেকে দু’হাত সামনেই দীপু পাপা। লোকটার দিকে আমার মনোযোগ রয়েছে। সে আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন আমরা বেশ পরিচিত। অথচ মনে হচ্ছে তাকে আমি আগে কখনো দেখিনি। তার ঠোঁটের কোণায় হাসি। হতে পারে সে আমাকে চিনে। কিন্তু সে যে স্বস্তিতে নেই এবং সেটা আমার কারণে- সেটা বুঝেছি প্রথমবার তার দিকে তাকানোর পরই। অথচ সে কি-না হাসছে! তার অবস্থাটা দেখে আমার হঠাৎ হাসি পেল। তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। তার বোকা বোকা হাসিটা আরো বেড়ে গেল। তা দেখে আমার হাসিও বেড়ে গেল। আমি বেশ বুঝতে পারছি আমাকে দেখে সে “বিপদগ্রস্থ হাসি” হাসছে । এবার আমি শব্দ করে হাসতে শুরু করলাম। আমি হাসলেও বিল্ডিংটা গমগম করতে থাকে। সিঁড়িতে সেটা আরো বেশী হয়। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। হাসি পেলে আমি চট্ করে থামাতে পারি না। হাসতেই থাকি। দীপু একটুও না হেসে, শান্তভাবে লোকটাকে বললো – “ওর পিছনে পিছনে কেউ উঠছে, এটা ও পছন্দ করে না।” কথাটা ঠিক। দীপুর কথা শুনে লোকটা প্রায় থেমেই গেল। কিঞ্চিত ভয় মেশানো অস্বস্তিতে পড়ে গেল লোকটা এবার। মজার ব্যাপার হলো- তবু মুখটা সে জোর করে হাসি হাসি করে রেখেছে। তা দেখে আমার হাসি থামতে চাইছে না। আমি শব্দ করে হেসেই যাচ্ছি। ছয় তলা বিল্ডিং-এ আমাদের বাসাটা তিন তলায়। লোকটাকে খেয়াল করতে করতে দোতলা পর্যন্ত ওভাবেই উঠার পর হাসিটা একটু থামাতে চাইলাম। বারবার তবুও, বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত উপচে আসছে হাসির একেকটা ঢেউ। কোনরকমে নিজেকে সামলাতে সামলাতে- লোকটার আরো কাছ থেকে, তার চোখের ঠিক আরো গভীরে দেখার জন্যে, উপরে না উঠে- হঠাৎ তার দিকে যেতে শুরু করলাম। লোকটা প্রথমে থেমে গেল। এরপর একপা পিছিয়ে গেল। ভয় পেয়েছে! আমার হাসি চলে আসছে আবারো। এ’সময়ে হঠাৎ পিছন থেকে দীপু পাপা আমার হাত ধরে ফেললো- “আব্বু, কাম অন।” দীপুর কথা শুনে আমি নিজেকে সামলে আবারো উঠতে শুরু করলাম। কিন্তু হাসি থামাতে পারছি না। হা হা করে হাসতে হাসতে সিঁড়ি ভাঙছি। আমার শরীর বাঁকা হয়ে যাচ্ছে হাসির দমকে। ওভাবেই হাসতে হাসতেই বাসায় ঢুকলাম। বাসায় ঢোকার পরও আমার হাসি থামাতে পারছিলাম না অনেকক্ষণ পর্যন্ত। কিন্তু আমার হাসির এ’সময়ে, সবাই গম্ভীর হয়ে যার যার কাজ করছিল।
দুই।।
পেশাব পেলে আমার সাংঘাতিক হাসি পায়। হাসতে হাসতে আমার চোখ ফেটে পানি বেরুতে থাকে। সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে আমি হাসতে থাকি। ঘামতেও থাকি। কিন্তু এই হাসি থামানোর সাধ্যি তখন আমার থাকে না। এটা ঘটে আমার অনুভূতিগত জটিলতার কারণে। এ’সময়ে সবাই হয়তো যে যার মত কাজে ব্যস্ত। অথচ আমি হয়তো পড়ে গেছি তখন নিয়ন্ত্রণহীন এক কাতুকুতুর গর্তে। যে গর্তে পড়লে আমার হাসি আর থামাতে পারি না। আমার বীনু আম্মু অনেক ছোট বেলাতেই আমার এই সমস্যাটা ধরতে পেরেছিল। হাসতে হাসতে আমি অনেক সময়ে, তখন প্যান্টেই পেশাব করে দিতাম। এরপর থেকে আমি হাসলেই, সবাই বুঝতে চাইতো আমার পেশাব পেল কি-না। বাথরুমে গিয়ে আমি হাসতে হাসতে পেশাব করতে থাকি। তবে সবসময়েই যে পেশাব পেলেই হাসি পায় –এমনটা নয়। আমি বেশীরভাগ সময়েই স্বাভাবিক পেশাব করতে পারি। যদিও আমাকে রুটিনমাফিক এ’কাজটা করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু অনেক সময়েই পেশাব না- পেলেও, নিয়ন্ত্রণহীন হাসির কারণে- দীপু কিংবা বীনু আমার হাত ধরে জোর করে টানাটানি করতে থাকে আর বারবার বলতে থাকে- “নাফি বাথরুমে যাবে। পিসু করবে। আসো। কাম অন।” অথচ তখন হয়তো আমি হাসছি অন্য কোন কারণে। কিন্তু ভুল করে টানাটানি করলে, আমি হাসিটা কোনভাবে থামানোর জন্য যুদ্ধ করি নিজের সাথে। সেটা যতক্ষণ না-পারি ততক্ষণ আমাকে নিয়ে টানাটানি চলতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত আমি কোনরকমে কয়েক মুহুর্তের জন্য হাসি থামাতে পারি। তখন বুঝতে পেরে আমাকে যেই ছেড়ে দেয় অমনি আমার অনেক কষ্টে আটকে রাখা হাসি হুড়মুড় করে আবারও ছিটকে বেরিয়ে আসে। এভাবে অনেকটা সময় ধরে নিজের সাথে নিজেকেই যুদ্ধ করতে হয় এই হাসি থামানোর জন্যে। সামলাতে হয়- নিজেকেই নিজে।
তিন।।
অনেক ছোট ছোট আনন্দ-ও অনেক সময়ে, বেশী অনুভূত হয় আমার কাছে। যে আনন্দে একজন সাধারণ মানুষ মনে মনে শুধু মৃদু খুশিই হতে পারে, সেই একই আনন্দে আমি হয়তো বিশাল একটা লাফ দিয়ে, তীব্র চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করতে পারি এবং অনেকক্ষণ হাসতে পারি। অনেক সময়ে এমনটা ঘটে যে- কিছু একটা চাইতে গিয়ে কিংবা কাউকে কিছু একটা বোঝাতে গিয়ে আমি একটা জটিলতার ভিতরে পড়ে যাই। কিন্তু হঠাৎ যদি সেটা সহজেই মিটে যায়- তাহলেও কিছুক্ষণ হাসতে পারি। কিন্তু এটাও অনেক সময়ে ঘটে যায়- যে কাঁদতে যেয়ে হেসে ফেলেছি। যেটা শুধুই আমার প্রকাশ করার অক্ষমতা এবং অনুভূতিগত জটিলতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। আবার- সবার অলক্ষ্যে বিছানায় শুয়ে মাস্টারবেশন করার পর অদ্ভুত আনন্দদায়ক এবং তীব্র যে অনুভূতি আমার সমস্ত শরীর এবং অস্তিত্বে ছড়িয়ে পড়ে- তাতে আমি অনেক সময়েই হেসে ফেলি। সেটা কিন্তু নিঃশব্দ হাসি। আমার এমন নিঃশব্দ হাসি দেখে দীপু পাপা এগিয়ে আসে এবং আমার গোসলের ব্যবস্থা করে।
বাসায় রুটি বানাতে আসে যে মানুষটা বীনু এবং দীপু তাকে খালা বলে ডাকে। সেই বয়স্ক মানুষটা একটা ছন্দে কাজ করে। সে যখন এই রুটি বানানোর কাজটা শুরু করে আমি তার পাশে একটা টুলে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখতে থাকি। সে একটা সিকোয়েন্স অনুসরণ করে যখন কাজটা করে, তখন শেষের দিকে এসে অনেক আনন্দে আমি তার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসতে থাকি। কিন্তু সে হাসে না। আমি একা একাই হাসতে থাকি। আবার, এমন অনেক হাসির কারণ আছে যা দীপু পাপা কিংবা বীনু আম্মু এখনো জানে না- কেন হাসতে হাসতে আমার চোখে পানি চলে আসে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। (চলবে)

৪র্থ পর্বঃ প্রকৃতির আবর্ত-(২) আত্মকথাঃ ফারহান আরিফ নাফি

এটা মাত্র ক’দিন আগের কথা। গভীর রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে। আমি বসে আছি। দীপু পাপা সাধারণতঃ ঘুমায় ভোর বেলায়। কিন্তু আজ সেও ঘুমিয়ে গেছে। আমি খেয়াল করলাম বীনু-আম্মু, দীপু-পাপা এবং জয়ী কেউ-ই সঠিক পোশাক পরে নেই। অথচ আমি ঘুমানোর আগেও দেখেছিলাম সব ঠিক আছে। তারমানে হলো-আমি ঘুমানোর পরেই, সবাই পোশাক পাল্টে ফেলেছে। মানে সিকোয়েন্স ভেঙ্গে ফেলেছে। আমি অন্ধকারেই একা একা বারান্দায় গিয়ে সবার পোশাকগুলো খুঁজে নিয়ে আসলাম। এরপর দীপুর হাত ধরতেই সে উঠে বসলো এবং বুঝে ফেললো কি করতে হবে। সে কোন কথা না-বলে, দ্রুত আমার হাত থেকে নিয়েই তার ডেনিম জিনসের প্যান্ট আর ছাই রঙের টি-শার্টটা পরে ফেললো। বাকী রইলো বীনু-আম্মু আর জয়ী। আমি কী বলতে চাইছি, দীপু পাপা সেটা বুঝতে পেরেই বীনুকে ডাক দিয়ে পোশাক পাল্টাতে বললো। বীনু তার পোশাক হাতে নিয়েই আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বললো- “এখন রাত বাজে ৩টা। পোশাক পাল্টানো যাবে না।” এরপর ধমকের সুরে আমাকে বললো- “ঘুমাও।” আমার হয়ে দীপুই বললো- “আহা, এমন করো কেন? পরো না, ভাই। পরলেই তো ঝামেলা মিটে যায়।” বীনু আরো বিরক্ত হয়ে বললো- “আমি এখন ভেজা জামা-কাপড় পরবো নাকি? বললেই হলো? এই ভেজা জামা পরলে আমি সুস্থ থাকবো? সকালে আমার স্কুল আছে।” বীনুর জামাটা হাতে নিয়ে আমি ঠোঁটে ছোঁয়ালাম। সেটা সত্যিই ভেজা ছিল। দীপুরটাও সামান্য ভেজা ছিল। কিন্তু সে ভেজাটাই পরে ফেলেছে। আমাদের কথার তোড়েই জয়ী উঠে বসেছে। ভয়ার্ত চোখে দেখছে সবাইকে। জয়ীর জামাটাও ভেজা ছিল। বুঝতে পারছি আমার কথা কেউ শুনবে না। এবং প্রচন্ড রাগে ঠিক তখনই আমি নিয়ন্ত্রণ হারালাম। প্রচন্ড চিৎকার দিয়ে প্রথম আক্রমন করলাম- দীপুকে। অনবরত মারতে থাকলাম আর খামচাতে থাকলাম ওকে। সে ল্যাং মেরে ফেলে দিল আমাকে আমার বিছানায়। এরপর চেপে ধরলো আমাকে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে। আমি গগনবিদারী চিৎকার করতে থাকলাম। চিৎকার থামাতে দীপু সব শক্তি দিয়ে আমার পেটের উপরে বসে- তার দুই হাঁটু আর বাম হাত দিয়ে, আমার দুই হাত চেপে ধরলো। ডান হাতে চেপে ধরলো আমার মুখ। কয়েকটা মূহুর্ত কেটে গেল চুপচাপ ওভাবেই। এরপর আমি সহজ হয়েছি ভেবে সে ছেড়ে দিল আমাকে। কিন্তু আমি আসলে সহজ হতে পারছি না। বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত প্রচন্ড রাগ উথলে উঠছে আমার। হঠাৎ করেই চিৎকার করতে করতে নিজের মাথায় জোরে জোরে মারতে শুরু করলাম। দ্রুত এসে দীপু পাপা আবার চেপে ধরলো আমাকে। আমিও সমস্ত শক্তি দিয়ে সুযোগ মত মারছি ওকে। সে এরপর আমার মাথায় থাপ্পড় মারলো অনেকগুলো। কিন্তু এটা সে করে আমাকে ভয় দেখানোর জন্যে এবং অনেক সময় রাগের থেকেও করে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে- একই সাথে এই দু’টো কারণেই সে মারছে আমাকে। তাতে আমার রাগ আরো বেড়ে গেল। তীব্র রাগের যন্ত্রনায় আমার সমস্ত শরীর ভয়ন্করভাবে কাঁপছে। আমার চিৎকার থামাতে আগের মতই কৌশল করে, দীপু আমার মুখ চেপে ধরলো। কিন্তু এবার সে এত জোরে চেপে ধরেছে যে- দাঁতের সাথে প্রচন্ড চাপে আমার ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে আসছে। এই মূহুর্তে ওকে আমার প্রাণের শত্রু মনে হচ্ছে। আমার বিষ্ফোরিত রক্তলাল চোখে তাকিয়ে আছি দীপুর চোখে। দীপুর টি-শার্টটা অনেক আগেই একটানে ছিঁড়ে ফেলেছি। ছেঁড়া জামাটা বিশ্রীভাবে তার গায়ে ঝুলছে। ওর চোখেও এখন অনেক রাগ, সাথে সামাজিক ভয়। কারণ আশেপাশেই কোন বাচ্চার ঘুম ছুটে গেছে আমার চিৎকারে। ভয়ার্ত কান্নার আওয়াজ শুনছি। অনেক মানুষের কথাও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সে’সব আমাকে স্পর্শ করছে না। এবং আমার রাগ কিছুতেই কমছে না।
আমাকে নিয়ন্ত্রনের প্রথম ধাপটা হলো বিছানার সাথে কিছুক্ষণ চেপে ধরে রাখা। এরপর ভেজা গামছা দিয়ে আমার চোখ মুখ এবং মাথা মুছে দেয়া। সেটা করতেই- দীপু তার দুই হাটু দিয়ে আমার দুই হাত চেপে ধরে রেখেছে। বাম হাতে চেপে ধরেছে আমার মুখ- যেন চিৎকার করতে না-পরি। এই অবস্থাতেই, হাঁপাতে হাঁপাতে সে বীনুকে বললো- “তাড়াতাড়ি গামছাটা ভিজিয়ে আনো। বীনু দ্রুত ভেজা গামছাটা ধরিয়ে দিল দীপুর হাতে। সে আমার মুখ চোখ এবং মাথা ভেজা গামছাটা দিয়ে মুছে দিতে থাকলো। একটু পরে আমি ঠান্ডা হয়েছি ভেবে যেই মাত্র দীপু আমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে অমনি হ্যাঁচকা এক টানে জানালার পর্দা খুলে ফেললাম। রাগ হলে পর্দাটা এভাবেই ছিঁড়তে চেষ্টা করি বলে, আমাদের বাসার সমস্ত পর্দাগুলো কাপড় নাড়া ক্লিপ দিয়ে লাগানো থাকে- আমি টান মারলে যাতে ছিড়ে না-যায়। কারণ, অতীতে অনেক পর্দা আমি ছিঁড়ে ফেলেছি। বালিশ কামড়ে ছিঁড়ে আমার শরীর আর ঘর তুলাময় করে ফেলেছি। পর্দাটা ছিঁড়লো না বলে এরপর নিজের হাতে নিজেই ভয়ন্কর এক কামড় বসিয়ে ধরে রাখলাম অনেকক্ষণ। অনেক অটিষ্টিক বাচ্চাই, যারা হাইপার একটিভিটি- তারা এটা করে। নিজের হাতে নিজেই কামড় বসিয়ে দেয়। এ’কারণে তাদের হাতে সারাজীবনই কামড়ের কালচে দাগটা থেকে যায়। আম্মু বলে- অটিষ্টিক মানুষরা বেশীর ভাগই অশান্ত গোছের হয়। হাইপার এক্টিভিটিস যারা দেখায়- তাদের সংখ্যাই বেশী। আর, আমিও সেই দলেরই একজন। মাঝে মাঝেই, আমিও হাইপার হয়ে পড়ি।
এখন- যেহেতু আমার রাগ কমেনি এবং চিৎকারও থামেনি। তাই চিৎকার থামাতে বারবার দীপু আমার মুখ চেপে ধরছে। নানা রকম চেষ্টা করছে। ভয় দেখাচ্ছে। আমি বিছানায় আধ শোয়া অবস্থাতেই ডান হাত দিয়ে আমার নিজের কান-মাথা জুড়ে ভয়ন্কর জোরে থাপ্পড় মারতে থাকলাম নিজেকেই। সেই সংগে মাঝে মাঝে দেয়ালে হাঁটু দিয়ে এত জোরে জোরে আঘাত করছি যে দুম দুম করে পুরো বিল্ডিং জুড়ে বিশাল শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, পুরো বিল্ডিংটাই কাঁপিয়ে দিচ্ছি আমার হাঁটুর আঘাতে। আমাকে থামাতে না-পেরে, একসময় দীপু জোর করে আমাকে বাথরুমে নিয়ে গেল। আমার উপরে এটা তার দ্বিতীয় কৌশল। এই সময়ে সে মগ ভরে ভরে প্রচুর পানি আমার মাথায় ঢালতে শুরু করলো। আমার রাগ আরো বেড়ে গেল। আমি সুযোগ পেলেই দীপুকে মারছি। এবং চিৎকার করছি। ভয়ন্কর চিৎকার। আমাকে ভয় দেখাতে গিয়ে আমার গায়ের টি শার্ট্ টাও দীপু ছিঁড়ে ফেলেছে। আমার যেহেতু মারামারির কৌশল জানা নেই, তাই ওর সাথে পেরে উঠছি না। কিন্তু শক্তিতে আমি দীপুর চেয়ে অনেক বেশী। সুতরাং শক্তি এবং নিয়ন্ত্রণহীন রাগের কারণেই আমি কিছুতেই হাল ছাড়তে রাজী না। দীপুর ডান হাতের কনুইয়ের চামড়া ছিঁড়ে নিয়েছি অনেকটা। আমারও চামড়া ছঁড়ে গেছে কয়েক জায়গায়। জ্বলছে কিন্তু জ্বলুনীটা গায়ে মাখছি না। কোন কৌশল কাজ না-করাতে, দীপু এরপর শুরু করলো পানি দিয়ে আক্রমন। মগে ভরে-ভরে পানির বাড়ি মেরে বেশ কয়েকবার আঘাত করলো আমাকে। কয়েক মগ পানিও মাথায় ঢাললো এই সময়ে। কিন্তু আক্রোশ কমলো না আমার। দু’জনেই ভিজে এক শা। এরপর আবার জোর করে বাইরে নিয়ে এলো আমাকে। মারতে থাকলাম দু’জন দু’জনকে। এবার অনেকটা শক্তি হারিয়েছি আমি। তাই আমার চিৎকারও তখন কিছুটা কমে গেছে।
এখানে, যে কথাটা আমার বলা দরকার, তাহলো- আমাদের এক অন্যকে করা- কারো আঘাতই কিন্তু বাস্তবে তেমন জোরালো হয় না। আমার ক্ষেত্রে যা হয়- তাহলো শক্তি আছে কিন্তু প্রয়োগের ব্যর্থতার কারণে সেটা হয়ে যায়- একটা মধ্যম শক্তির কিলের মত। আর যেটা পারি তাহলো- খাঁমচে রক্ত বের করে দিতে পারি। বেশীর ভাগই করি বীনু কিংবা দীপুর হাতে আর পিঠে। দীপু আমার আঘাতগুলো ব্লক করতে পারে। কিন্তু বীনু সেটা পারে না। তাই রাগ হলে ইচ্ছে মত বীনুকে খামচে ধরে রক্তাক্ত করি। আম্মুর হাতে আমার খামচির আঘাত সব সময়ই যে কেউ দেখতে পাবে। দীপু যে আঘাতগুলো আমাকে করে- সেটা হয় ঠাস্-ঠুস্ থাপ্পড় টাইপের। এবং সে আমার মাথায় আঘাত করে। আমি জানি- “আমাকে ভয় দেখানো কিংবা আঘাত করা” যাই সে করুক না কেন- সেটা সে করে “যেভাবেই হোক আমাকে থামানোর জন্যে।” তবে আমি যখন নিজেকে যখন নিজে আঘাত করি, সেটা সত্যিই ভয়ন্কর শক্তিতে করি। কিন্তু আমার ছোট বোন জয়ীকে কখনো আঘাত করি না। বেশ অনেক বছর আগে, ওর অনেক ছোটবেলায় একবার শুধু আঘাত করেছিলাম। দাঁত মুখ খিঁচে, ই-ই-ই করতে করতে ওর হাতের নরম মাংশ পেশীতে প্রচন্ড একটা চিমটি দিয়েছিলাম। ও তখন অনেক কান্না করেছিল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার অনেক খারাপ লেগেছিল। এরপর আমি হঠাৎ করেই একদম শান্ত হয়ে যাই। আর কোনদিন ওকে আমি আঘাত করিনি। তখন আঘাত করার আর কোন কৌশলও আমি জানতাম না। চিমটি কাটার কায়দাটা আমার সহজাত প্রবৃত্তি থেকে পাওয়া- আঘাত করার একটা কৌশল। আর এটা আমি রেগে যাওয়া মাত্রই, হাতের কাছে যাকে পেতাম তার উপরেই তখন প্রয়োগ করতাম এই কৌশলটা।
যাই হোক, এ’ মুহুর্তে আমাদের দু’জনের যা হচ্ছে- দীপুর মুখে কোন শব্দ নেই। কিন্তু আমার চিৎকার সম্ভবতঃ তখনও আশেপাশের অনেকেই শুনতে পাচ্ছে। আমি ক্লান্ত হচ্ছি কি-না অনেক আশা নিয়ে বারবার দীপু সেটা বুঝতে চাচ্ছে- আমার চোখের দিকে তাকিয়ে। কারণ দীপুর শক্তি প্রায় শেষ। কিন্তু আমি থামছি না দেখেই ঠিক এরপরের কৌশলটাকেই সে শেষ রাউন্ড হিসাবে ধরে নিয়ে আমার সামনে দাঁড়ালো। আমাকে বললো- “মারো আমাকে। কিন্তু তুমি যতটা মারবে আমিও ততটা মারবো তোমাকে।” ইতমধ্যে আমিও অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এবং চিৎকারও করছি না আর। দু’জনের মাঝখানে দূরত্ব এক ফিটের মত। হাপরের মত দু’জনেই হাপাচ্ছি। শুরু হলো রেসলিং ষ্টাইলের ফাইট। মানে- প্রতিরোধবিহীন মারামারি। এই ষ্টাইলে আমি একবার আঘাত করবো, তারপর তার পালা- সেও একবার আঘাত করবে আমাকে। ওর এই কৌশলটা গতবার কাজ করেছিল- বেশ তাড়াতাড়ি। মারপিট থামিয়ে দিয়েছিলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। মেনে নিয়েছিলাম পরাজয়। এবার রাগ পড়ছে না সহজে। হারতেও চাচ্ছি না। তাই দীপুর এই কৌশলটাও কাজ করছে না। আমরা ১০/১২টা আঘাত লেনদেন শেষ করলাম। কিন্তু আমার থামার কোন লক্ষণ নেই। আরো কিছুক্ষণ এইভাবে নিঃশব্দে পালা করে আঘাত বিনিময় করলাম আমরা। শুধু দীপুর নয়, আমারও হাতে আর কোন শক্তি নেই। দু’জনেরই আঘাতগুলো শক্তি হারিয়ে হাস্যকর রকমের দুর্বল হয়ে গেছে। কোন কথা ছাড়াই আরো কিছুক্ষণ চললো এই হাস্যকর আঘাত বিনিময়। শেষের আঘাতটা আমিই করলাম দীপুকে। বিনিময়ে সে আর আঘাত করেনি আমাকে। এভাবেই আমাকে জিতিয়ে দিল সে। কিন্তু আমি তো আসলে হেরে গেলাম। সবার কাছেই। কেউ বুঝলো না আমাকে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি সবার পোশাকের সিকোয়েন্সটা ঠিক রাখার জন্যে। কিন্তু পারিনি। সবাই মিলে জোর করে হারিয়ে দিল আমাকে। তার জন্যে অনেক আঘাত করলো আমাকে।
এরপর, দীপু-পাপা আমার হাত ধরে নরম সুরে বললো বিছানায় চলো। ঘুমাবে এবার। আমি তার কথা মেনে নিলাম বিনা আপত্তিতে। বিছানায় যখন গেলাম তখন প্রায় সকাল হয়ে গেছে। আমি শুয়ে পড়েছি। দীপু পাপা আমার পাশে বসে বারবার আমাকে আদর করছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমার নাকে নাক ঘষছে। মাথায় চুমু দিচ্ছে বারবার। ভালবাসা জানাচ্ছে। ফিসফিস করে বারবার সরি বলছে আমাকে। আমি জানি দীপু-পাপা আমাকে বুঝতে পেরেছিল। তার কথা ভাবতে ভাবতে আমার ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। সবকিছু ভুলে গিয়ে একটু পরেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। (চলবে)

৩য় পর্বঃ প্রকৃতির আবর্ত-(১) আত্মকথাঃ ফারহান আরিফ নাফি

অটিষ্টিক মানুষরা একটা সিকোয়েন্স অনুসরণ করে চলে। আর হ্যাঁ, এটা তোমরাও জানো যে- প্রকৃতিরও একটা নিয়ম আছে। এবং সে তার নিয়ম ধরেই চলে। কিন্তু তোমরা অনেক সময়েই নিয়মকে ভেঙ্গে ফেল। যেহেতু সবকিছুতেই আমরা একটা সিকোয়েন্স (sequence: পর্যায়ক্রম) অনুসরণ করি, তাতে ভুল হবার কথা নয়। তবুও জটিল এই পৃথিবীতে বিচিত্র কারণে, অনেক কিছুরই সিকোয়েন্স ভেঙ্গে যায়- যেটা আমরা পছন্দ করি না। তাই, আমাদের সম্পর্কে বলা হয়- We don’t make mistake. We just repeat. সিকোয়েন্স যা দেয় তার নাম নিরাপত্তা বা নিশ্চয়তা। একটা নিশ্চিত বোধ ছাড়া, আমরা অটিস্টিক মানুষগুলো চলতে পারি না। চলতে চাইও না। সকালবেলা আম্মুর সাথে যখন স্কুলে যাই- সেটার একটা সিকোয়েন্স আছে। ঘুম থেকে উঠা থেকে শুরু করে- বাসে উঠা পর্যন্ত, সব কিছুরই একটা পর্যায়ক্রম আছে। কিন্তু এটা প্রায়ই হয় যে- বাসে উঠার পর দেখা গেল আমি জানালার পাশে যে সিটে বসি, সেখানে অপরিচিত একজন মানুষ আমার পছন্দ-করা সিটে বসে আছে। মানে- সিকোয়েন্সটা ঠিক নেই। আমি এখানেই বসবো। ফলে, আমি অপরিচিত মানুষটার হাত ধরি। যেহেতু আমি কথা বলতে পারছি না, তাই আলগোছে তার হাতটা ধরে তার চোখের দিকে তাকাই। সে বিষ্ময় এবং প্রশ্নবোধক চোখে আমার দিকে তাকায়। এবং সে বুঝতে পারে না- ঠিক কি হতে যাচ্ছে। আম্মু তাড়াতাড়ি এসে আমাকে টানাটানি করতে থাকে- অন্য কোথাও বসার জন্যে। কিন্তু আমি তো কোন ভুল করছি বলে মনে হয় না। আমি নাছোড়বান্দার মত দাড়িয়ে থাকি। বেশীরভাগ মানুষই আমাকে সিটটা ছেড়ে দিয়ে ‘আমার সিটে’ বসতে দেয়। আমার ভাল লাগে। সিটে বসেই আমি হাসি। একাকীই হাসি। অনেক আনন্দে আমি সামনে-পিছে শরীর দোলাতে থাকি। জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে থাকি। আমার ভাল লাগে। কারণ এখন সিকোয়েন্স অনুযায়ী সবকিছু ঠিক আছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আমার ভীষণ ভাল লাগে স্কুলে যেতে। আমি বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সাঁ সাঁ করে পিছনে সরে যেতে থাকা বস্তু গুলোকে দেখতে থাকি। এ’দেখার ভিতরে একটা অদ্ভূত আকর্ষণ আছে। আমি দেখতেই থাকি। কিন্তু আমি এটাও জানি- বাসের ভিতরে অনেকগুলো চোখ আমাকেই দেখছে। অথচ আমি দেখতে একদমই সাধারণ আর দশজন মানুষের মত। বাইরে থেকে আমাকে আলাদা করে দেখার মত কিছুই নেই। তবু কি মনে করে, বাসে প্রায় সময়েই কেউ-না-কেউ আম্মুর কাছে জানতে চায়- আমার সমস্যাটা কী। বুঝতে চায়- আমি পাগল কি-না। আমার মাথায় কোন গন্ডগোল আছে কি-না। এই প্রশ্ন বরাবর আম্মুর একই উত্তর- “ওর অটিজম আছে।” অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেউই বোঝেনা অটিজম কী।
বাসায় নতুন যে সিকোয়েন্সটা আমি খেয়াল করে বুঝতে পেরেছি সেটা হলো আমাদের বাসার প্রত্যেকের পোশাক পরার বিষয়টা। সবাইকে একসাথে বদলাতে হবে এবং যেটা খোলা হবে- সেটা ধুতে হবে। গোসল করলে পোশাক বদলাতে হবে। কে, কোন পোশাকটা পরবে তারও একটা সিকোয়েন্স আছে। আবার যখন সকাল হবে সবাই একসাথে পোশাক বদলে ফেলবে। অর্থাৎ স্কুলে যাওয়ার আগে এবং স্কুল থেকে ফেরার পরে সবাই পোশাক বদলাবে। কিন্তু এই পোশাক বদলানো নিয়ে অনেক সমস্যা হচ্ছে। কেউ ঠিক মত সিকোয়েন্সটা ফলো করতে চাইছে না। আমি যখন স্কুল থেকে বাসায় ফিরি তখন দীপু পাপা আর জয়ী বাসায় থাকে। দীপু কিছুটা এগিয়ে এসে আমাদেরকে রিসিভ করে। সে আমার হাত থেকে স্কুল ব্যাগটা নেয়। আজও এই পর্যন্ত সব কিছু ঠিক ছিল। এরপর, বাসায় ফিরেই আমরা, মানে আমি আর বীনু-আম্মু পোশাক পাল্টে ফেলেছি। সিকোয়েন্সটা ঠিক রাখতে তাই দীপু পাপা এবং জয়ীকেও পোশাক পাল্টাতে হবে। ওরা পাল্টাচ্ছে না দেখে- আমি দ্রুত দীপু আর জয়ীর পরবর্তী পোশাকটা বারান্দা থেকে এনে দিলাম। দীপু পাপা বারবার বলতে থাকলো – এটা তো ভেজা। আমি আমার ঠোঁট ছোঁয়ালাম তার জিনসের প্যান্ট আর টি শার্টে। হ্যাঁ, ভেজাই তো। কোন কিছু ভেজা নাকি শুকনো সেটা আমি অনুভব করি আমার ঠোঁট দিয়ে। কিন্তু দীপু পাপা এখন এই পোশাকটা পরতে চাচ্ছে না। মানে সিকোয়েন্সটা ঠিক রাখতে চাচ্ছে না। আমি বুঝতে পারছি ওর ভুল হচ্ছে। অথচ আমি ঠিক কাজটা করতে চাচ্ছি। কিন্তু সবাই একসাথে আমাকেই বকা দিচ্ছে এবং বাঁধা দিচ্ছে। আমি প্রচন্ড রেগে যাচ্ছি। রাগলে আমার নিজের উপরে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে আমি ঠিক কাজটা করতে চাই। আমি বোঝাতে চাইছি- তোমাদের ভুল হচ্ছে। আমার রেগে যাওয়া দেখেই দীপু পাপা ভেজা প্যান্ট আর টি শার্টটা পরে ফেললো। আমি খুশি হলাম। বাকী রইলো জয়ী। সেও পরিস্থিতি বুঝে তাড়াতাড়ি পাল্টে নিল তার পোশাকটা। বেশীর ভাগ সময়েই খুলে ফেলা পোশাক গুলো নিয়ে বাথরুমের মেঝেতে ফেলে- তার উপরে মগ ভরে ভরে পানি ঢালতে থাকি। এ’গুলো এখন ধুতে হবে। কেউ একজন- দীপু কিংবা বীনু, সেটা করে ফেলবে। আমার পছন্দ দীপুকেই। আমি ওর হাত ধরলাম। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম আমার কথাটা। সে বুঝলো। আমাকে খুশি করতে সাথে সাথেই বাথরুমে গিয়ে কাপড়গুলো ধুতে শুরু করে দিল। কাপড় ধোয়ারও একটা ছন্দ আছে। আছে সিকোয়েন্স। আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে সেই সিকোয়েন্সটা ঠিক আছে কি-না, দেখতে থাকলাম। দীপু সিকোয়েন্স ঠিক রেখে কাপড়গুলো ধুয়ে বারান্দার তারে নেড়ে দিল। অনেক খুশিতে আমি একটা বিশাল লাফ দিলাম। সেই সংগে বিকট এক চিৎকার দিয়ে আমার আনন্দ প্রকাশ করলাম। এরপর দীপুর কাছে গিয়ে ওর নাকে আমার নাকটা ঘষে দিলাম। ওকে ভালবাসা জানালাম। ও হাসলো। সবাই হাসলো। মনের আনন্দে আমি বিছানায় গেলাম। প্রচন্ড গরমেও আমার প্রিয় ব্লান্কেটা গলা পর্যন্ত টেনে নিলাম- খুশি মনে। মাথার নিচে তিনটা বালিশ। কান চাপা দিলাম আরেকটা বালিশ দিয়ে। এ’বার কিছুক্ষণ বিশ্রাম করবো। একটু পরেই বীনু মজার একটা নাস্তা দিবে। সন্ধ্যার নাস্তা। ততক্ষণে একটু জিরিয়ে নিব। আমি দিনে কখনোই ঘুমাই না। এমন কি রাতেও মাঝে মাঝে জেগে থাকি। অটিষ্টিক মানুষরা তিন চার দিন না ঘুমিয়েও দিব্যি স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারে। যেহেতু এটা ঘুমানোর সময় নয়। তাই ডুবে গেলাম আমার ভাবনার জগতে। টিভিটার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়েও কিছু সময় পার করে দেই এই সময়টা। সন্ধ্যার নাস্তাটা সেরেই আমি ঘামতে ঘামতে বাথরুম করবো। প্রচুর ঘামি বলে আমার আম্মু দুষ্টুমি করে আমাকে ঘর্মরাজ বলে। দীপু পাপা আমাকে বাথরুমে সাহায্য করে। আমি একাকী বাথরুম করতে পারিনা। কিন্তু অনেক ঘেমেছি বলেই বাথরুম শেষ হতে-না-হতেই দীপু পাপা আমার গায়ে জামা-কাপড়ের উপর দিয়েই পানি ঢেলে দিল। তারমানে এখন আমাকে সে গোসল করাবে। আমি বিরক্ত প্রকাশ করলেও মেনে নিলাম। আমি গোসল করতে চাইবো না বলেই, এ’কাজটা সে এ’ভাবে করে থাকে। তাই এখন আমি অপছন্দ করলেও গোসল করতে বাধ্য হবো। কিন্তু কেউ বুঝতে পারছে না যেটা তাহলো- সবাইকেই এখন পোশাক পাল্টাতে হবে। কারণ পোশাকতো আমরা সবাই একসাথে পাল্টাই। আমার টেনশনটা হলো দীপু পাপা সেটা মানলেও বীনু আর জয়ী আমাকে বাধা দিবে। তাই রাগ এবং জোর দিয়েই এরপর শুরু হলো আমার সেই প্রাণান্তকর চেষ্টা। রাগের চোটে নেংটু হয়েই, সবার পরবর্তী পোশাক খুঁজতে বারান্দায় ছুটে গেলাম। দীপুও ছুটলো আমার পিছনে পিছনে। খুঁজে পেতে ওদেরকে ওদের পোশাক দিলাম। প্রথমে রাজী না-হলেও একসময় দীপু আর বীনু আমার নির্বাচিত পোশাক পরে নিল। কিন্তু জয়ী পাল্টাবে কী- সে ভয়ের চোটে খাটের কোণায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার আর জয়ীর মাঝখানে দীপু পাপা। কিন্তু জয়ীকে তো পোশাক পাল্টাতেই হবে। উত্তেজনায় আমিও খাটে উঠে গেলাম। খাটে উঠে দাঁড়ালে ফ্যানের থেকে আমার মাথার ব্যবধান থাকে মাত্র ছয় ইঞ্চি। আমার চিৎকার আর দাপাদাপিতে যে কোন দুর্ঘটনা এখন ঘটে যেতে পারে। বীনু তাড়াতাড়ি ফ্যানটা অফ করে দিল। আমার একটাই লক্ষ্য এখন- জয়ীকে তার পোশাক পাল্টাতে হবে। বীনু একটার পর একটা পোশাক দেখাতে থাকলো আমাকে- “আচ্ছা তুমিই বলো জয়ী কোনটা পরবে।” আমি সেদিকে মনোযোগ দিতে পারছি না। দীপু জোর করে আমাকে বিছানা থেকে নামিয়ে দিল। সুযোগ পেয়ে ধরে ফেললাম দীপুকে। কয়েকটা খামচি দিয়ে চেপে ধরলাম আমার সাথে। এটা করলাম ওকে ব্যথা দিতে। কিন্তু দীপু আজ নির্বিকার। কিছুতেই তার কোন রাগ হচ্ছে না। ঠিক এই সময়েই জয়ী দ্রুত পাল্টে ফেললো তার পোশাকটা। ফলে আমি ধীরে ধীরে ঠান্ডা হতে থাকলাম। দীপু পাপা আমার ঘাম মুছিয়ে দিল। এরপরের কাজটা দ্রুত শেষ করতে পারলে- কাজটার পুরো সিকোয়েন্সটা শেষ হবে। তাই আমি সবার খুলে ফেলা পোশাকগুলো বগলদাবা করে নিয়ে বাথরুমের দিকে ছুটে গেলাম। বালতিতে ফেলে দিয়ে, দ্রুত কয়েক মগ পানি ঢেলে কাপড়গুলো ভিজিয়ে তারপর শান্ত হলাম। এরপর বিছানায় গেলাম। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দীপু পাপা আমার পিছু পিছু আছেই। কখনো সে ঘাম মুছে দিচ্ছে। আবার কখনো সে আলাপের সুরে আমার সাথে কথা বলে যাচ্ছে। এরপরে ঘরের পরিবেশটা কিছু সময়ের মধ্যেই পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেল। আম্মু আমাকে আলুর চিপস ভেজে দিল। কয়েকটা খেয়েই- খুশিতে আমি সেগুলো দীপুকে নিজে হাতে খাইয়ে দিলাম। সে খেল। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। সেও হাসলো। এর কিছুক্ষণ পরেই দীপু পাপা আমাকে খুশি করতে দোকান থেকে আইসক্রিম নিয়ে এলো। আমি চাইলাম – দীপুও খাক। কিন্তু সে খেল না। বীনুকে দিল। বীনু কিছুটা খাওয়ার পরে তার কাছ থেকে আবার নিয়ে আমাকে খাওয়ালো বাকীটুকু। সবাই আমরা আবার স্বাভাবিক আনন্দে ফিরে গেলাম। বীনু শুয়ে শুয়ে টিভি দেখতে থাকলো। জয়ী পড়তে বসলো। দীপু গিয়ে বসলো কম্পিউটারে। আমি চুপচাপ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম।
কিন্তু এত কিছুর পরও কেউ বুঝতে পারছে না কিভাবে সিকোয়েন্সটা অনুসরণ করতে হবে। এর ভিতরে সবচে’ বেশী জটিলতা হয়েছে জয়ীকে নিয়ে। সে খুব ঘনঘন পোশাক পাল্টাতে থাকে। আমি তখন অসহায় বোধ করি। কী করবো বুঝতে পারি না। অথচ আমাদের সবার পোশাক পরার এই সিকোয়েন্সটা ঠিক রাখতে ক’দিন আগেই- কী যে ভয়ন্কর এক অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে- সেটা এর পরবর্তী পর্বে জানাবো। আরেকটি কথাও এখানে বলে রাখি- পোশাকের এই সিকোয়েন্স নিয়ে আমার ভাবনা দীর্ঘদিন চলবে। সেটা হতে পারে ছয় মাস কিংবা তারচে’ কম-বেশী কিছু কাল। এরপর আবার হয়তো নতুন কোন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাব। তখন ভুলেই যাব এই পোশাক বিষয়ক ভাবনার কথা। তাই এটা নিয়ে তোমাদের, অনেক টেনশনেরও কিছু নেই।

২য় পর্বঃ নিস্তব্ধ নিশি।। (আত্মকথাঃ ফারহান আরিফ নাফি)

গভীর রাত। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। বসে আছি আমার মাথায় ব্যবহার করা তিনটি বালিশের উপর। সেগুলি একটার উপরে আরেকটা- এ’ভাবে রাখা। ফ্লোরেই- এবং রুমের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ ঘেষে আমার ৮ফিট বাই ১০ফিটের বিছানা। দেয়ালের সাথে লাগোয়া বলে, কোণ ঘেষেই বালিশগুলো পাতা থাকে। মাথার পিছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছি। অনেকটা চেয়ারে বসার মত করে- হাঁটু ভাজ করে, দু’পা সামনে রাখা। ডিম লাইটের আলোয় অদ্ভূত কালচে-নীলাভ এই আলো-অন্ধকারে বসে আমার চারপাশের সবকিছুকে অনুভব করছি। উচ্চ শব্দগুলো এই সময়ে থাকে না। কিন্তু নিচু অনেক শব্দ আছে আমি শুনতে পাই। সাধারণ মানুষগুলো এইসব শব্দের বেশীর ভাগই শুনতে পায় না। তবে খেয়াল করলে তারাও নিশ্চয়ই কিছু শব্দ শুনতে পায়। কিন্তু আমার সংবেদনশীল কান প্রকৃতির অনেক শব্দ শুনতে পায়। দিনের আলো ফুটতে শুরু করার সাথে সাথে পৃথিবীটা যখন জেগে উঠতে শুরু করে, ধীরে ধীরে তার শব্দও বাড়তে থাকে- দ্রুত। এর অল্প কিছুক্ষণ পরই পৃথিবীটা বিশ্রী রকমের শব্দময় হয়ে ওঠে। আমি সকাল থেকেই দু’কানে আংগুল দিয়ে আমার প্রাত্যহিক কাজকর্ম শুরু করি। তাই, রাতের এই নিস্তব্ধতা আমার কাছে খুব অন্যরকম মনে হয়। ভাল লাগে। কিন্তু দিনে এবং রাতে মিলিয়ে সব সময়- এমন শান্ত এবং সুন্দর একটা পৃথিবী হয় না। হলে ভাল হতো! সেই পৃথিবীটার কথা আমি কাউকে কোনদিন বলতে পারবো না। তোমাদের কেউই কোনদিন কল্পনাও করতে পারবে না- “সেই পৃথিবীটা কত সুন্দর!
উচ্চ শব্দ থেকে কান ঢাকতে আমি যে বালিশটা ব্যবহার করি- সেটা এখন বুকের সাথে চেপে ধরে আছি। চিবুকটা নামিয়ে দিয়েছি বালিশের কানিতে। মাঝে মাঝে মুখটা তুলে দেখছি শান্ত চারপাশ। শব্দহীন দাড়িয়ে আছে ওয়াড্রোবটা। সারাদিন ওটার ড্রয়ারগুলো বহুবার খোলা হয়। সেও বিশ্রাম করছে। আমি অনেকক্ষণ ওয়াড্রোবটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মনে হচ্ছে ওর-ও প্রাণ আছে। আছে সুখ-দুঃখ, অনুভূতি। আমার মাথার কাছে, ঠিক ওপরেই আমার লাইফ-সাইজের একটা পোষ্টার আছে। সেখানে ছোটবেলার আমি। এটা আমার ৭ বছর বয়সের ছবি। ছবিতে হালকা হাসিমুখে, বড়-বড় চোখে তাকিয়ে আছি। ছবির ‘আমি’ সারাক্ষণ আমার দিকেই তাকিয়ে থাকে। যতবার তাকাই ততবারই দেখি সে আমাকেই দেখছে, আর আমি তাকে। এই অন্ধকারেও ওর দিকে একবার তাকালাম। আগের মতই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এটাই ওর একমাত্র কাজ- আমার দিকে তাকিয়ে থাকা। এই সময়টাতে টিভির মনিটরকে কুচকুচে কালো দেখায়। সারাদিনে ঘুরে ফিরে সবাই বারবার চোখ রাখে টিভিতে। টিভিটাও একের পর এক তার রকমারী এবং দুর্বোধ্য নানারকম ছবি দেখাতে থাকে। আমার মনে হয়- টিভিটার ঠিক ভিতরে কোথাও বিশাল একটা ভান্ডার রয়েছে এ’সবের। আর সে’ ভান্ডার থেকে যখন বাংলায় কিছু হয়, বিশেষ করে- ধীর লয়ের কিছু গান, সে’সব আমার ভাল লাগে। কিন্তু আমার ভাল লাগাটা যেহেতু আমি বোঝাতে পারি না, তাই এই বিষয়টা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মাঝে মাঝে অবশ্য বীনু-আম্মু কিংবা দীপু-পাপা আমার কথা বলে- ‘নাফি এটা পছন্দ করছে। ও দেখুক।’ আমি রিমোটের ব্যবহার জানি না। তাই আমি বাদে সবাই, বেশীরভাগ সময়েই, যে যার নিজের পছন্দ মত চ্যানেল দেখে। কিন্তু কখনো আমার ভাল লাগছে- এমন কোনকিছু যখন দেখছি, তখন দুম করে সেটা পাল্টে দিতে পারে যে কেউ। এবং দেয়ও। আমি নির্বিকার থাকি। অন্য কোথাও মনোযোগ দেই। সাধারণতঃ রিমোটটা হাতে নিয়েই কে কোন-কোন চ্যানেলগুলোতে যাবে- সেটা আমি অনুমান করতে পারি। আমার ছোট বোন জয়ী- সে রিমোট হাতে নিয়েই কার্টুন চালিয়ে দিবে। সে অবশ্য মাঝে মাঝে দীপু আর বীনুর সাথে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, স্টার মুভিজ এবং এইচবিও দেখে। আমি কিছু চ্যানেলের নাম জানি, কারণ, এই নাম গুলো বহুবার উচ্চারিত হয়েছে- আমি বাদে, ঘরের বাকী সবার মুখে।
সময়ের ব্যাপারটা আমি বুঝি না। তাই কয়টা বাজে জানি না। নিঃশব্দের ভিতর একমাত্র শব্দ হয়ে জেগে আছে শুধু সিলিং ফ্যানটা। ওটাকেও জীবন্ত মনে হয়। একাকীই নিজের কাজটা করে যাচ্ছে অনবরত, বিরামহীন। এরপর চোখ ফিরিয়ে তাকালাম আমার বুকের সাথে ধরা বালিশটার দিকে। একটা অদ্ভূত রকমের আপন-আপন ঘ্রান আছে এটায়। ভীষন টানে আমাকে। আমার সাথে দীর্ঘদিন ধরে আছে এই বালিশটা। এবং আমার অনেক আপন কিছু এটা। কোনভাবেই আমি এটাকে হারাতে চাই না। এমন কী ছিঁড়ে গেলেও না। আরও জোরে চেপে ধরলাম ওকে আমার বুকের সাথে। চেপে ধরেই- ধীর লয়ের কোন গানের সুরের মত গুনগুন একটা শব্দ করে যাচ্ছি। সমস্ত মনোযোগ দিয়ে আমার নাক-মুখ ঘষছি বালিশটার সাথে। হঠাৎ মনে হলো দীপু পাপা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ কোন শব্দ বা নড়াচড়া করেনি সে। তার দিকে না তাকিয়েও নিশ্চিত করে বলতে পারি সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! আমার অতিচেতনার অংশ আমাকে সেটা জানিয়ে দেয়। অনেক সময়েই- তাই আমি না-দেখলেও, অনেক কিছু বুঝতে পারি- এই যেমন এখন বুঝতে পারছি দীপু পাপা আমার দিকে তাকিয়ে আছে একভাবে। অথচ একটি বারও আমি তার দিকে তাকাইনি। কোন শব্দও পাইনি। সে শুয়ে আছে বড় খাটটায়। তার পাশে বীনু এবং বীনুর বাম পাশে জয়ী। কেন জানি রাতে দীপু ঘুমায় না। সারারাতই প্রায় জেগে কাটায়। কিন্তু আজ সে একটু আগেও ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি এটাও জানি- আমি উঠে দাঁডানো মাত্রই সেও উঠে আমার পিছু নেবে। সহানুভূতিমাখা নরম সুরে জানতে চাইবে- “কী হয়েছে, বাবা? আমাকে বল।” আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। ঠিক তাই, দীপু পাপা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ডিম লাইটের হালকা নীলাভ আলোয় আমাদের চোখাচোখি হলো। কিন্তু সে কোন কথা বললো না। শুধু তাকিয়েই আছে। জানি তার ভাবনার জগত জুড়ে এখন কেবল আমি। সে আমার সমস্ত ভাবনাগুলো বুঝতে চায়। আমার ভিতরে ঢুকে পড়তে চায়। কিন্তু আমি আমার অতিন্দ্রিয় চেতনার কারণে তার মনকে স্পষ্ট পড়তে পারছি। দীপু এই মূহুর্তে ভাবছে - “কোন ভয় নেই, আব্বু। - এই যে, আমি আছি!”
এরপর সে নেমে এসে বলবে- “ঠিক আছে, ঘুরে শো-ও আব্বু ।” আমি পু্ব-দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে কাত হয়ে শুলাম। সিকোয়েন্সের পরের অংশটা হলো- ও এখন আমার পিঠ চুলকাতে-চুলকাতে নিচু স্বরে গান গাইবে। নিচু স্বরেও সে ভাল গায়। সে গাইছে-
                            পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায় 
                         সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আজ ওর গান খুব ভাল হচ্ছে। অনেক ভালো লাগছে আমার। ওর গানের তালে আমার দুলতে ইচ্ছে করছে। আমি ঘুম বাদ দিয়ে দুম করে উঠে বসলাম। এরপর সেই গানের সুরে সুরে ভীষণভাবে দুলতে থাকলাম- নিঃশব্দে। ঠিক দীপুর চোখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। কিন্তু, আর… বাকী সবাই- সবার পৃথিবী তখন নিঃশব্দ আর তন্দ্রায় নিমজ্জিত। এরপর দীপু আরো কয়েকটি গান গাইল এবং পিঠ চুলকাতে থাকলো। একসময়ে আজান শুনলাম। দীপু থামলো। আমি শুয়ে পড়লাম। চৈত্রের ভয়ন্কর এই গরমেও মোটা ব্লান্কেটটা টেনে নিলাম গলা পর্যন্ত। অথচ ঘরের তাপমাত্রা এখন ৩১ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছুঁই ছুঁই। আমি ঘামছি। তাতে কোন সমস্যা নেই। ব্লান্কেটটা ব্যবহার করি মূলতঃ আমার শ্পর্শকাতর ত্বকের কারণে। ঠান্ডা, গরম এবং স্পর্শ- আমি একবারেই সাধারণ মানুষের মত অনুভব করি না। তা’ছাড়াও ব্লান্কেটের ব্যবহার আমাকে একটা নিরাপত্তা বোধের অনুভূতিও দেয়। ঘুমের আগে এটাই ছিল আমার শেষ ভাবনা। এ’ ভাবনার প্রায় সাথে সাথেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। (চলবে)

১ম পর্বঃ আমার চুলকাটা।। (আত্মকথাঃ ফারহান আরিফ নাফি)

লোকটাকে দেখেই চিনতে পারলাম। আমার চুল দাড়ি কাটতে এসেছে। খুবই খারাপ একটা সময় এটা। দীপু- মানে, আমার দীপু 
পাপা,সেই এই ছেলেটিকে বাসায় এনেছে। ছেলেটার নাম রাম। তার বয়স আমার চে’ একটু বেশী হতে পারে। রামের নিজের 
সেলুন আছে এই পাড়াতেই। তার সেলুনে প্রথমবার যখন চুল দাড়ি কাটতে যাই, অন্যদের মত সেও আমার দিকে অবাক হয়ে 
তাকিয়েছিল। রাম কথা খুব কম বলে। সে কোন কথা না-বলে চুল কাটতে শুরু করেছিল। তার সেলুনটা যথেষ্ট বড় নয়। 
বরং খুবই সংকীর্ণ জায়গায় দু’টো চেয়ার রেখে, কোন রকমে কাজ চালিয়ে নেয় রাম। ছাদটা একেবারে নিচু। আমি লম্বায় 
৫ফিট ৮ইঞ্চি। দাঁড়ানো অবস্থায় আমার মাথার সোজা- মাত্র ৯ইঞ্চি উপরেই, একটা তিন পাখাওয়ালা ফ্যান ঘুরছিল 
বিপদজ্জনকভাবে। চুল কাটা শুরু করেছিলাম তাই- অনেক অস্বস্তি নিয়ে। আর এই অস্বস্তির কারণেই আমার চুল কাটার 
সিকোয়েন্সগুলো দ্রুত শেষ করতে চাইছিলাম। আমার সমস্ত মনোযোগও তাই দ্রুত চুল কাটা শেষ করানোর দিকেই ছিল। আমাকে 
দেখে অবশ্য বোঝার কোন উপায় ছিল না- ভিতরে-ভিতরে কী তীব্র একটা অস্বস্তিতে আমি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। 
সিকোয়েন্সের ২য় অংশ হলো- আমার বগলের চুলগুলোকে কেটে ফেলে পরিস্কার করা। রাম বুঝতে পারছিল না আরো তাড়াতাড়ি 
সবকিছু শেষ করতে হবে। আমার ইন্দ্রিয়গত সংবেদনশীলতার কারণে, সাধারণ মানুষের চাইতে অনেক বেশী মাত্রায় তথ্য আমার
মস্তিষ্ক গ্রহন করে থাকে। যা বেশীর ভাগ সময়েই আমাকে স্বাভাবিক মানুষের মত চিন্তা এবং চলাফেরায় বাধাগ্রস্থ করে। 
এ’কারণেই আমার মনের অতিচেতনার অংশ বলছিল এটা খারাপ জায়গা। তাই আমাকে দ্রুত সবকিছু শেষ করে এখান থেকে 
বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সে’কথা আমি কাউকে বোঝানোর চেষ্টাও করতে পারি না। কারণ, কারো সাথে যোগাযোগ কিভাবে 
করতে হয়- আমি সেটা পারি না। জানি না- ঠিক কিভাবে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সাথে কথার মাধ্যমে যোগাযোগ 
স্থাপন করে। আমার একেকটা অনুভূতি অন্যান্য নানা ধরনের অনুভূতিগুলোর ভিতর দিয়ে ঠেলাঠেলি করে বেরিয়ে আসতে চায়। 
শেষে লাইনচ্যূত ট্রেনের মত অনুভূতিটা লাইনচ্যূত হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে অন্যান্য অনুভূতির সাথে এবং অবশেষে আমার কণ্ঠ 
থেকে বেরিয়ে অাসে ভিন্ন কোন শব্দ হয়ে- যার কোন অর্থ হয় না। কিন্তু আমি বোবাও নই! বোবা মানুষগুলো সাধারণতঃ 
বধির হয়ে থাকে। আমি বধির তো নই-ই, বরং সাধারণ মানুষদের তুলনায় আমার শ্রবণেন্দ্রিয় অনেক বেশী মাত্রায় সংবেদনশীল।
অনেক সূক্ষ্ণ শব্দও আমি শুনতে পাই। শব্দ শুনেই বুঝতে পারি- সারা বাড়িতে কোথায়, কে কী করছে। কিন্তু তীক্ষ্ণ শব্দ এবং 
উচ্চ শব্দ আমার কাছে ভীষণ পীড়াদায়ক অনুভূত হয়। এ’জন্যে আমাকে সারাক্ষণ দু’কানে অাঙ্গুল দিয়ে চলাফেরা করতে হয়। 
কিন্তু এ’সবের মানে এই নয় যে আমি কিছু বুঝি না। কিংবা একেবারে কিছুই বলতে পারি না, তাও নয়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই
আমার দৃষ্টিভঙ্গি সবার থেকে আলাদা। আমি হয় চুপ হয়ে থাকি অথবা আমার সেই অদ্ভূত-ভিন্ন শব্দগুলোকেই বারবার প্রকাশ 
করতে থাকি। এটা বেশী করি- যখন অাপন মনে থাকি। এবং এটা অনেকটা ঠিক নিজেকেই নিজে শোনানোর মত। তাই- 
আমি অন্যদের মত বোঝাতে পারি না- আমি কী ভাবছি। আমাকে অনেক যুদ্ধ করতে হয় নিজেকে বোঝানোর জন্যে।       
কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সেলুনের তখনকার মূহুর্তটা আমার কাছে তীব্র পীড়াদায়ক মনে হচ্ছিল। ভুলে গেলাম মাথার উপরে ঘুরতে 
থাকা ফ্যানের কথা। ফলে, চুল কাটা শেষ হওয়ার আগেই আমার বগল পরিস্কার করানোর জন্যে দুম করে উঠে দাড়িয়ে 
সিকোয়েন্সের ২য় অংশটাও শেষ করতে চাইলাম। কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই এবং কেউ আমাকে বাঁধা দেবার আগেই, 
যেই মাত্র আমি আমার ডান হাতটা উঁচু করেছি ঠিক তখনই ঘটে গেল দুর্ঘটনাটা। মাথার উপরে ঘুরতে থাকা ফ্যানে আমার 
হাতটা প্রচন্ড জোরে একটা বাড়ি খেল। সংগে সংগে বেশ জোরে একটা শব্দ হলো। চোখের পলকে একসাথে ঘটে গেল অনেক কিছু।
ফ্যানটা আমার হাতের ধাক্কায় একমূহুর্ত থেমে থেকে আবারও ঘুরতে শুরু করলো এবং সেই সংগে দোলনার মত দুলছেও। 
রাম ছেলেটা ভয়ের চোটে এক দৌড়ে সেলুনের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। তার চোখে মুখে আতংক। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। 
দীপু পাপা দ্রুত আমার হাতে কোথায় ব্যথা পেলাম এবং আমি কেমন বোধ করছি- আমার হাত আর মুখ দেখে সেটা বুঝতে
চেষ্টা করছে। না, কোন রক্ত বের হয়নি। আসলে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে আমার কোন ভাবান্তরও হয়নি আর। চুপচাপ 
প্রতিক্রিয়াহীন মানুষের মত বসে আছি। আমার মন তখন শান্ত-দীঘির পানির মত শান্ত। আসলে এ’ ধরনের আঘাতে অন্য যে
কোন সাধারণ মানুষের মত প্রতিক্রিয়া আমার হয় না। আমাকে নির্বিকার দেখে এবং রামের আতংকিত মুখ দেখে দীপু পাপা
হেসে ফেললো। সেটা কিন্তু তার কৃত্রিম হাসি ছিল! এরপর হাসিমুখে রামকে বললো- ‘আরে কিছুই তো হয়নি। তুমি ভয় পাচ্ছ 
কেন? ফ্যানের সাথে সামান্য একটা বাড়ি খেয়েছে শুধু- আর কিছু না। আসো, আসো।’ রাম এলো এবং ভয়ে ভয়ে সে কাজ 
শুরু করলো- যেখানে শেষ করেছিল, সেখান থেকে। ঐ সেলুনটাই ছিল এখন পর্যন্ত আমার শেষ সেলুন। আসলে এরপর থেকেই 
চুল কাটানোর জন্যে দীপু পাপা আমাকে নিয়ে আর কোথাও যায়নি। আজ আমার চুল কাটার দিন। তাই রামকেই বাসায় আনা 
হয়েছে। রাম যখন এলো তখন সময়টা প্রায় শেষ বিকেল। একটু পরেই ঝুপ করে বাইরে অন্ধকার নামবে। কাল দুপুর থেকে 
মোট তিনবার, আমার মানসিক প্রস্তুতির জন্যে দীপু পাপা আমাকে বুঝিয়েছে আজ আমার চুল কাটা হবে। ঐ ঘটনার পর থেকে 
গত কয়েক মাস যাবৎ আমার চুল কাটানোর কাজটা বাসায় করানো হচেছ।       
রামের সেলুনটা ছাড়াও আমাদের এই পাড়ায় আরো একটা সেলুন আছে। সেটা বেশ সুন্দর এবং বড়। কিন্তু সেটায় আমার চুল 
কাটতেই চায়নি। এবং প্রথমবারেই দেখেছিলাম- সেলুনের চুল কাটানোর লোকটা আমার দিকে বেশ তাচ্ছিল্য করেই তাকিয়েছিল। 
দীপু পাপা সেটা ঠিকই ধরতে পেরেছিল। দীপুর ভাবনাগুলো আমি বেশ বুঝতে পারি। তখন তার কী রাগ! রাগে গজ্ গজ্ 
করতে-করতে সেলুনের লোকটাকে বারবার ছাগল বলছিল। লোকটা অবশ্য সেটা শুনতে পাচ্ছিল না। আরেকটা সেলুন ছিল- 
বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। সেটাতেও আমার চুল কাটতে চাইতো না। সেই ছেলেটাও প্রায় আমার বয়সী ছিল। তার চোখ 
দেখেই বুঝতাম- সেও তাচ্ছিল্য করতো আমাকে। বিশেষ দয়ায় ২বার চুল কেটেছিল। তৃতীয়বার কোন কারণ ছাড়াই, 
আর কাটতো চাইলো না। ফিরিয়ে দিল আমাকে। দীপু পাপার মুখটা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম- সে তীব্র রাগ আর অপমান 
বোধ করেছিল। এবং আমার তখন মনে হয়েছিল পাপা যে কোন খারাপ কিছু করে ফেলতে পারে। আবার ভাল একটা সমাধানও 
করে ফেলতে পারে। যেটা ভাল হবে ঠিক আমার জন্যে। সে অবশ্য ভালটাই করে বেশির ভাগ সময়ে। কিন্তু খুব খারাপ 
দেখাচিছল দীপু পাপার মুখটা সেদিন। এর কিছুদিন পর সেই সেলুনটা বন্ধ হয়ে যায়। লুকাসের মোড়ের সেলুনটাও আমার 
অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে দ্বিগুন টাকা চেয়েছিল। অথচ অন্যদের চে’ আমার চুল কাটানোয় ঝামেলা অনেক কম ছিল। 
আমি আমার স্পর্শকাতর ত্বকের কারণে গায়ে কোন কাপড়, যার উপরে কাটা-চুল পড়বে, তেমন কিছু জড়াতে পারি না। 
কারণ আমার শরীরে শুধু মাত্র বিশেষ ধরনের নরম কাপড়(knit fabric) ছাড়া অন্য কোন ধরনের কাপড়ের স্পর্শ নিতে 
পারি না। ফলে, খালি গায়ে চেয়ারে শুধু বসে পড়লেই হলো। আমার চুল ছাটা, বগল পরিস্কার এবং শেভ- এই তিনটি কাজ 
অনেক কম ঝামেলায় এবং কম সময়ে শেষ হয়ে যায়। তবু তারা অনেক বেশী দাবী করেছিল- আমাকে তাদের বিশেষ দয়ায় 
চুল কেটেছিল বলে। দীপু সেটা দেয়নি এবং রাগের চোটে ওদের ওখানে আমাকে নেয়া বন্ধ করে দিলো। আমাদের গলির এই 
বড় সেলুনটা আমাকে তাচ্ছিল্য করে ফিরিয়ে দিলেও, আমি জানি- দীপু এবার নাছোড় বান্দার মত লোকটাকে নিয়ে ভাবতে 
থাকবে। ভেবে একটা সমাধান ঠিকই বের করে ফেলবে। ইতমধ্যে আমার চুল-দাড়ি বিশ্রী রকমের বড় হয়ে গেছে। সারাদিনই 
খুব অস্বস্তি বোধ হয় সে’ জন্যে। এর বেশ কিছুদিন পরে, প্রথমবারের মত, পাড়ার নতুন বড় সেলুনটায় চুল কাটতে 
পেরেছিলাম। রাগ আর অপমান চেপে রেখে খাতির জমাতে গিয়ে দীপু অনেক কথা বললো তাদের সাথে। আলাপের সুরে সে 
আমার সম্পর্কে চুল কাটানোওয়ালা লোকটাকে ধারনা দিতে থাকলো- অটিজম কী, পৃথিবীতে কতজন বিজ্ঞানী অটিজমে আক্রান্ত 
ছিলেন, তারপরে কাটা-পড়া চুলের ছোট ছোট টুকরোর খোঁচা আমার ঘাড়ে কেমন অনুভূতি তৈরী করে, অটিজম নিয়ে সরকার 
কী কী করছে- এইসব অনবরত বলতে থাকে। আমার মোটেও ভাল লাগেনা দীপু পাপা যখন ওদেরকে এইসব কথা বলতে থাকে। 
কারণ ওরা এসব বোঝে না। কিন্তু বোঝার ভান করে। আমি এই সময়ে চুপচাপ এবং তাড়াতাড়ি সব কিছু শেষ করে বাসায় 
ফিরতে চাই। খারাপ লাগার যেটা হলো- তাহলো দীপু পাপা যে এত কষ্ট করে ওদের সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করলো তাতে 
কোন লাভ হলো না। আমি বেশ বুঝতে পারছি দীপু পাপাকে ওরা বোকা একজন মানুষ মনে করেছে। ওদের ভুল হয়েছে। 
দীপু পাপা দেখতে খুব সাধারণ হলেও অনেক অন্যরকম তার চিন্তা-ভাবনার জগত। তো, দীপু পাপাকে ওরা সাধারণ আর বোকা 
মানুষ ভেবেই দেড়গুণ টাকা বেশী চেয়ে ফেললো! কিন্তু দীপু পাপা যে সেটা দিবে না- আমি জানতাম। কারণটা মোটেই অক্ষমতা 
নয়। বরং কারণটা এটাই যে ওরা আমার সাথে অন্যায় করছে। তাই দেড়গুণ বেশী টাকা যে দীপু দিবে না- সেটা বুঝতে 
পেরেছিলাম। ঐ পরিমাণ টাকা দীপু দেয়নি বলে বড় ছেলেটা আমাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে ছোট ছেলেটাকে নির্দেশ দিল- 
‘তুই আর হের চুল কাটবি না। আইজকেই শ্যাষ’। মজার ব্যাপার হলো- আমাকে আর আমার পাপাকে ওরা বোকা ভেবেছে। 
আসলে কিন্তু ওদের বুদ্ধি এত কম যে- আমরা, মানে আমি আর আমার পাপা কে কী ভেবেছিলাম- ওরা সেটা একটুও বুঝতে 
পারেনি। আমরা কিন্তু ঠিকই বুঝেছিলাম- ওরা কে কী ভেবেছিল সে’দিন। এটাকে বলে সেন্স অব এমপ্যাথি (sense of 
empathy)। মানে অন্যকে বোঝার ক্ষমতা। অন্যের অনুভূতি ধরতে পারা। যা ওদের নেই। কিন্তু জন্মগতভাবেই এটা আমার 
ভেতরে আছে অনেক বেশী মাত্রায়। (চলবে)