Thursday, December 21, 2017

৪র্থ পর্বঃ প্রকৃতির আবর্ত-(২) আত্মকথাঃ ফারহান আরিফ নাফি

এটা মাত্র ক’দিন আগের কথা। গভীর রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে। আমি বসে আছি। দীপু পাপা সাধারণতঃ ঘুমায় ভোর বেলায়। কিন্তু আজ সেও ঘুমিয়ে গেছে। আমি খেয়াল করলাম বীনু-আম্মু, দীপু-পাপা এবং জয়ী কেউ-ই সঠিক পোশাক পরে নেই। অথচ আমি ঘুমানোর আগেও দেখেছিলাম সব ঠিক আছে। তারমানে হলো-আমি ঘুমানোর পরেই, সবাই পোশাক পাল্টে ফেলেছে। মানে সিকোয়েন্স ভেঙ্গে ফেলেছে। আমি অন্ধকারেই একা একা বারান্দায় গিয়ে সবার পোশাকগুলো খুঁজে নিয়ে আসলাম। এরপর দীপুর হাত ধরতেই সে উঠে বসলো এবং বুঝে ফেললো কি করতে হবে। সে কোন কথা না-বলে, দ্রুত আমার হাত থেকে নিয়েই তার ডেনিম জিনসের প্যান্ট আর ছাই রঙের টি-শার্টটা পরে ফেললো। বাকী রইলো বীনু-আম্মু আর জয়ী। আমি কী বলতে চাইছি, দীপু পাপা সেটা বুঝতে পেরেই বীনুকে ডাক দিয়ে পোশাক পাল্টাতে বললো। বীনু তার পোশাক হাতে নিয়েই আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বললো- “এখন রাত বাজে ৩টা। পোশাক পাল্টানো যাবে না।” এরপর ধমকের সুরে আমাকে বললো- “ঘুমাও।” আমার হয়ে দীপুই বললো- “আহা, এমন করো কেন? পরো না, ভাই। পরলেই তো ঝামেলা মিটে যায়।” বীনু আরো বিরক্ত হয়ে বললো- “আমি এখন ভেজা জামা-কাপড় পরবো নাকি? বললেই হলো? এই ভেজা জামা পরলে আমি সুস্থ থাকবো? সকালে আমার স্কুল আছে।” বীনুর জামাটা হাতে নিয়ে আমি ঠোঁটে ছোঁয়ালাম। সেটা সত্যিই ভেজা ছিল। দীপুরটাও সামান্য ভেজা ছিল। কিন্তু সে ভেজাটাই পরে ফেলেছে। আমাদের কথার তোড়েই জয়ী উঠে বসেছে। ভয়ার্ত চোখে দেখছে সবাইকে। জয়ীর জামাটাও ভেজা ছিল। বুঝতে পারছি আমার কথা কেউ শুনবে না। এবং প্রচন্ড রাগে ঠিক তখনই আমি নিয়ন্ত্রণ হারালাম। প্রচন্ড চিৎকার দিয়ে প্রথম আক্রমন করলাম- দীপুকে। অনবরত মারতে থাকলাম আর খামচাতে থাকলাম ওকে। সে ল্যাং মেরে ফেলে দিল আমাকে আমার বিছানায়। এরপর চেপে ধরলো আমাকে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে। আমি গগনবিদারী চিৎকার করতে থাকলাম। চিৎকার থামাতে দীপু সব শক্তি দিয়ে আমার পেটের উপরে বসে- তার দুই হাঁটু আর বাম হাত দিয়ে, আমার দুই হাত চেপে ধরলো। ডান হাতে চেপে ধরলো আমার মুখ। কয়েকটা মূহুর্ত কেটে গেল চুপচাপ ওভাবেই। এরপর আমি সহজ হয়েছি ভেবে সে ছেড়ে দিল আমাকে। কিন্তু আমি আসলে সহজ হতে পারছি না। বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত প্রচন্ড রাগ উথলে উঠছে আমার। হঠাৎ করেই চিৎকার করতে করতে নিজের মাথায় জোরে জোরে মারতে শুরু করলাম। দ্রুত এসে দীপু পাপা আবার চেপে ধরলো আমাকে। আমিও সমস্ত শক্তি দিয়ে সুযোগ মত মারছি ওকে। সে এরপর আমার মাথায় থাপ্পড় মারলো অনেকগুলো। কিন্তু এটা সে করে আমাকে ভয় দেখানোর জন্যে এবং অনেক সময় রাগের থেকেও করে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে- একই সাথে এই দু’টো কারণেই সে মারছে আমাকে। তাতে আমার রাগ আরো বেড়ে গেল। তীব্র রাগের যন্ত্রনায় আমার সমস্ত শরীর ভয়ন্করভাবে কাঁপছে। আমার চিৎকার থামাতে আগের মতই কৌশল করে, দীপু আমার মুখ চেপে ধরলো। কিন্তু এবার সে এত জোরে চেপে ধরেছে যে- দাঁতের সাথে প্রচন্ড চাপে আমার ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে আসছে। এই মূহুর্তে ওকে আমার প্রাণের শত্রু মনে হচ্ছে। আমার বিষ্ফোরিত রক্তলাল চোখে তাকিয়ে আছি দীপুর চোখে। দীপুর টি-শার্টটা অনেক আগেই একটানে ছিঁড়ে ফেলেছি। ছেঁড়া জামাটা বিশ্রীভাবে তার গায়ে ঝুলছে। ওর চোখেও এখন অনেক রাগ, সাথে সামাজিক ভয়। কারণ আশেপাশেই কোন বাচ্চার ঘুম ছুটে গেছে আমার চিৎকারে। ভয়ার্ত কান্নার আওয়াজ শুনছি। অনেক মানুষের কথাও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সে’সব আমাকে স্পর্শ করছে না। এবং আমার রাগ কিছুতেই কমছে না।
আমাকে নিয়ন্ত্রনের প্রথম ধাপটা হলো বিছানার সাথে কিছুক্ষণ চেপে ধরে রাখা। এরপর ভেজা গামছা দিয়ে আমার চোখ মুখ এবং মাথা মুছে দেয়া। সেটা করতেই- দীপু তার দুই হাটু দিয়ে আমার দুই হাত চেপে ধরে রেখেছে। বাম হাতে চেপে ধরেছে আমার মুখ- যেন চিৎকার করতে না-পরি। এই অবস্থাতেই, হাঁপাতে হাঁপাতে সে বীনুকে বললো- “তাড়াতাড়ি গামছাটা ভিজিয়ে আনো। বীনু দ্রুত ভেজা গামছাটা ধরিয়ে দিল দীপুর হাতে। সে আমার মুখ চোখ এবং মাথা ভেজা গামছাটা দিয়ে মুছে দিতে থাকলো। একটু পরে আমি ঠান্ডা হয়েছি ভেবে যেই মাত্র দীপু আমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে অমনি হ্যাঁচকা এক টানে জানালার পর্দা খুলে ফেললাম। রাগ হলে পর্দাটা এভাবেই ছিঁড়তে চেষ্টা করি বলে, আমাদের বাসার সমস্ত পর্দাগুলো কাপড় নাড়া ক্লিপ দিয়ে লাগানো থাকে- আমি টান মারলে যাতে ছিড়ে না-যায়। কারণ, অতীতে অনেক পর্দা আমি ছিঁড়ে ফেলেছি। বালিশ কামড়ে ছিঁড়ে আমার শরীর আর ঘর তুলাময় করে ফেলেছি। পর্দাটা ছিঁড়লো না বলে এরপর নিজের হাতে নিজেই ভয়ন্কর এক কামড় বসিয়ে ধরে রাখলাম অনেকক্ষণ। অনেক অটিষ্টিক বাচ্চাই, যারা হাইপার একটিভিটি- তারা এটা করে। নিজের হাতে নিজেই কামড় বসিয়ে দেয়। এ’কারণে তাদের হাতে সারাজীবনই কামড়ের কালচে দাগটা থেকে যায়। আম্মু বলে- অটিষ্টিক মানুষরা বেশীর ভাগই অশান্ত গোছের হয়। হাইপার এক্টিভিটিস যারা দেখায়- তাদের সংখ্যাই বেশী। আর, আমিও সেই দলেরই একজন। মাঝে মাঝেই, আমিও হাইপার হয়ে পড়ি।
এখন- যেহেতু আমার রাগ কমেনি এবং চিৎকারও থামেনি। তাই চিৎকার থামাতে বারবার দীপু আমার মুখ চেপে ধরছে। নানা রকম চেষ্টা করছে। ভয় দেখাচ্ছে। আমি বিছানায় আধ শোয়া অবস্থাতেই ডান হাত দিয়ে আমার নিজের কান-মাথা জুড়ে ভয়ন্কর জোরে থাপ্পড় মারতে থাকলাম নিজেকেই। সেই সংগে মাঝে মাঝে দেয়ালে হাঁটু দিয়ে এত জোরে জোরে আঘাত করছি যে দুম দুম করে পুরো বিল্ডিং জুড়ে বিশাল শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, পুরো বিল্ডিংটাই কাঁপিয়ে দিচ্ছি আমার হাঁটুর আঘাতে। আমাকে থামাতে না-পেরে, একসময় দীপু জোর করে আমাকে বাথরুমে নিয়ে গেল। আমার উপরে এটা তার দ্বিতীয় কৌশল। এই সময়ে সে মগ ভরে ভরে প্রচুর পানি আমার মাথায় ঢালতে শুরু করলো। আমার রাগ আরো বেড়ে গেল। আমি সুযোগ পেলেই দীপুকে মারছি। এবং চিৎকার করছি। ভয়ন্কর চিৎকার। আমাকে ভয় দেখাতে গিয়ে আমার গায়ের টি শার্ট্ টাও দীপু ছিঁড়ে ফেলেছে। আমার যেহেতু মারামারির কৌশল জানা নেই, তাই ওর সাথে পেরে উঠছি না। কিন্তু শক্তিতে আমি দীপুর চেয়ে অনেক বেশী। সুতরাং শক্তি এবং নিয়ন্ত্রণহীন রাগের কারণেই আমি কিছুতেই হাল ছাড়তে রাজী না। দীপুর ডান হাতের কনুইয়ের চামড়া ছিঁড়ে নিয়েছি অনেকটা। আমারও চামড়া ছঁড়ে গেছে কয়েক জায়গায়। জ্বলছে কিন্তু জ্বলুনীটা গায়ে মাখছি না। কোন কৌশল কাজ না-করাতে, দীপু এরপর শুরু করলো পানি দিয়ে আক্রমন। মগে ভরে-ভরে পানির বাড়ি মেরে বেশ কয়েকবার আঘাত করলো আমাকে। কয়েক মগ পানিও মাথায় ঢাললো এই সময়ে। কিন্তু আক্রোশ কমলো না আমার। দু’জনেই ভিজে এক শা। এরপর আবার জোর করে বাইরে নিয়ে এলো আমাকে। মারতে থাকলাম দু’জন দু’জনকে। এবার অনেকটা শক্তি হারিয়েছি আমি। তাই আমার চিৎকারও তখন কিছুটা কমে গেছে।
এখানে, যে কথাটা আমার বলা দরকার, তাহলো- আমাদের এক অন্যকে করা- কারো আঘাতই কিন্তু বাস্তবে তেমন জোরালো হয় না। আমার ক্ষেত্রে যা হয়- তাহলো শক্তি আছে কিন্তু প্রয়োগের ব্যর্থতার কারণে সেটা হয়ে যায়- একটা মধ্যম শক্তির কিলের মত। আর যেটা পারি তাহলো- খাঁমচে রক্ত বের করে দিতে পারি। বেশীর ভাগই করি বীনু কিংবা দীপুর হাতে আর পিঠে। দীপু আমার আঘাতগুলো ব্লক করতে পারে। কিন্তু বীনু সেটা পারে না। তাই রাগ হলে ইচ্ছে মত বীনুকে খামচে ধরে রক্তাক্ত করি। আম্মুর হাতে আমার খামচির আঘাত সব সময়ই যে কেউ দেখতে পাবে। দীপু যে আঘাতগুলো আমাকে করে- সেটা হয় ঠাস্-ঠুস্ থাপ্পড় টাইপের। এবং সে আমার মাথায় আঘাত করে। আমি জানি- “আমাকে ভয় দেখানো কিংবা আঘাত করা” যাই সে করুক না কেন- সেটা সে করে “যেভাবেই হোক আমাকে থামানোর জন্যে।” তবে আমি যখন নিজেকে যখন নিজে আঘাত করি, সেটা সত্যিই ভয়ন্কর শক্তিতে করি। কিন্তু আমার ছোট বোন জয়ীকে কখনো আঘাত করি না। বেশ অনেক বছর আগে, ওর অনেক ছোটবেলায় একবার শুধু আঘাত করেছিলাম। দাঁত মুখ খিঁচে, ই-ই-ই করতে করতে ওর হাতের নরম মাংশ পেশীতে প্রচন্ড একটা চিমটি দিয়েছিলাম। ও তখন অনেক কান্না করেছিল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার অনেক খারাপ লেগেছিল। এরপর আমি হঠাৎ করেই একদম শান্ত হয়ে যাই। আর কোনদিন ওকে আমি আঘাত করিনি। তখন আঘাত করার আর কোন কৌশলও আমি জানতাম না। চিমটি কাটার কায়দাটা আমার সহজাত প্রবৃত্তি থেকে পাওয়া- আঘাত করার একটা কৌশল। আর এটা আমি রেগে যাওয়া মাত্রই, হাতের কাছে যাকে পেতাম তার উপরেই তখন প্রয়োগ করতাম এই কৌশলটা।
যাই হোক, এ’ মুহুর্তে আমাদের দু’জনের যা হচ্ছে- দীপুর মুখে কোন শব্দ নেই। কিন্তু আমার চিৎকার সম্ভবতঃ তখনও আশেপাশের অনেকেই শুনতে পাচ্ছে। আমি ক্লান্ত হচ্ছি কি-না অনেক আশা নিয়ে বারবার দীপু সেটা বুঝতে চাচ্ছে- আমার চোখের দিকে তাকিয়ে। কারণ দীপুর শক্তি প্রায় শেষ। কিন্তু আমি থামছি না দেখেই ঠিক এরপরের কৌশলটাকেই সে শেষ রাউন্ড হিসাবে ধরে নিয়ে আমার সামনে দাঁড়ালো। আমাকে বললো- “মারো আমাকে। কিন্তু তুমি যতটা মারবে আমিও ততটা মারবো তোমাকে।” ইতমধ্যে আমিও অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এবং চিৎকারও করছি না আর। দু’জনের মাঝখানে দূরত্ব এক ফিটের মত। হাপরের মত দু’জনেই হাপাচ্ছি। শুরু হলো রেসলিং ষ্টাইলের ফাইট। মানে- প্রতিরোধবিহীন মারামারি। এই ষ্টাইলে আমি একবার আঘাত করবো, তারপর তার পালা- সেও একবার আঘাত করবে আমাকে। ওর এই কৌশলটা গতবার কাজ করেছিল- বেশ তাড়াতাড়ি। মারপিট থামিয়ে দিয়েছিলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। মেনে নিয়েছিলাম পরাজয়। এবার রাগ পড়ছে না সহজে। হারতেও চাচ্ছি না। তাই দীপুর এই কৌশলটাও কাজ করছে না। আমরা ১০/১২টা আঘাত লেনদেন শেষ করলাম। কিন্তু আমার থামার কোন লক্ষণ নেই। আরো কিছুক্ষণ এইভাবে নিঃশব্দে পালা করে আঘাত বিনিময় করলাম আমরা। শুধু দীপুর নয়, আমারও হাতে আর কোন শক্তি নেই। দু’জনেরই আঘাতগুলো শক্তি হারিয়ে হাস্যকর রকমের দুর্বল হয়ে গেছে। কোন কথা ছাড়াই আরো কিছুক্ষণ চললো এই হাস্যকর আঘাত বিনিময়। শেষের আঘাতটা আমিই করলাম দীপুকে। বিনিময়ে সে আর আঘাত করেনি আমাকে। এভাবেই আমাকে জিতিয়ে দিল সে। কিন্তু আমি তো আসলে হেরে গেলাম। সবার কাছেই। কেউ বুঝলো না আমাকে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি সবার পোশাকের সিকোয়েন্সটা ঠিক রাখার জন্যে। কিন্তু পারিনি। সবাই মিলে জোর করে হারিয়ে দিল আমাকে। তার জন্যে অনেক আঘাত করলো আমাকে।
এরপর, দীপু-পাপা আমার হাত ধরে নরম সুরে বললো বিছানায় চলো। ঘুমাবে এবার। আমি তার কথা মেনে নিলাম বিনা আপত্তিতে। বিছানায় যখন গেলাম তখন প্রায় সকাল হয়ে গেছে। আমি শুয়ে পড়েছি। দীপু পাপা আমার পাশে বসে বারবার আমাকে আদর করছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমার নাকে নাক ঘষছে। মাথায় চুমু দিচ্ছে বারবার। ভালবাসা জানাচ্ছে। ফিসফিস করে বারবার সরি বলছে আমাকে। আমি জানি দীপু-পাপা আমাকে বুঝতে পেরেছিল। তার কথা ভাবতে ভাবতে আমার ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। সবকিছু ভুলে গিয়ে একটু পরেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। (চলবে)

No comments:

Post a Comment