Friday, December 7, 2018

১০ম পর্বঃ আমার ভিতরে বাহিরে (আত্মকথাঃ ফারহান আরিফ নাফি)

এক।। 
আমার- কারো কাছে কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। যা কিছু বোঝার- আমি আমার জ্ঞানতঃ বুঝে নেই। তাই কারো কাছে
আমার কোন প্রশ্নও নেই। হ্যাঁ, এটাও সত্যি যে, আমার কোন স্বপ্ন নেই। ভবিষ্যতের কোন স্বপ্ন আমি দেখি না। ‍সত্যি বলতে কী
অটিজম আছে- এমন মানুষগুলোর ভাবনায়- ভবিষ্যৎ কালটাই নেই। শুধু ভবিষ্যৎ কাল কেন, আমরা অতীতকাল নিয়েও 
তোমাদের মত মাথা ঘামাই না। তাই, আমি বেঁচে থাকি শুধু বর্তমান কালকে নিয়ে।  তবে প্রকৃতি আমাকে এমন কিছু পারগতা 
দিয়েছে যার সাহায্যে আমি- তোমার চোখ দিয়ে দেখতে পারি। তোমার অনুভূতিকে হুবহু অনুভব করতে পারি। আমার এই শক্তি 
আমাকে শিখতে সাহায্য করে। এমনকি এটা আমাকে সতর্ক হতেও সাহায্য করে। আমি যখন তোমার দিকে তাকাই, তোমার চোখ 
এবং  ঠোঁটের দিকে আমার তীক্ষ্ণ মনোযোগ থাকে। প্রতিটি শব্দে তোমার প্রতিক্রিয়া আমি মনে রাখি। আমার মস্তিকে তোমার 
অনুভূতির একটা নিখুঁত ছবি তৈরী হয়। এবং সেটা এতটাই নিখুঁত যে- তুমি কল্পনা করেও তা পেতে পার না। তোমার মনে 
হতে পারে আমি ঠিক স্বাভাবিক নই। কিন্তু আমি আমার জন্যে ভীষণভাবেই স্বাভাবিক। 
 
দুই।।
স্কুলে আমার শিক্ষকরা আমাকে শিখতে সাহায্য করে। কিন্তু সেটা যতটা না তাদের মতো করে, তার চে’ বেশী তাঁরা করেন 
সে’ভাবে- যে’ভাবে ঠিক আমি শিখতে পারি। এমন মনে করার কোন কারণ নেই যে অটিজম আছে এমন মানুষগুলো সবাই 
আমার মতো! সে’কারণেই সবার শিক্ষা পদ্ধতিও একই রকমের নয়। বরং আমরা প্রত্যেকেই আলাদা। আমার যেমন- স্পর্শ 
এবং শ্রবণকাতরতা আছে আরেকজনের সেটা নাও থাকতে পারে। কেউ হয়তো ঘূর্ণায়মান বস্তুর প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। 
কেউ হয়তো বিচিত্র কোন কারণে প্রথম দেখা, নতুন মানুষটার মাথার গন্ধ শুঁকে নিতে পছন্দ করে। কেউ হয়তো সবকিছুই 
জিহ্বা দিয়ে অনুভব করতে চায়। সেটা লোহা, কাপড় কিংবা মাটি যাই হোক না-কেন। আমি যেমন কোন কাপড় ভেজা কি-না,
সেটা ঠোঁট দিয়ে অনুভব করি। কেউ হয়তো খুবই শান্ত। আবার কেউ হয়তো হঠাৎ রেগে যায়, এমনকি কাউকে আক্রমণও করে 
বসতে পারে। কেই হয়তো লিখতে পারে,পড়তেও পারে। আবার কেউ শুধু হয়তো এ’দুটির একটিই পারে। হতে পারে- কেউ 
কোনটাই পারে না। কেউ হয়তো কথাও বলতে পারে। কেউ হয়তো পারে না। আমি যেমন কথা বলে উঠি কখনো কখনো। 
আমি কথা বলার পর খেয়াল করে দেখি বাসার সবার চোখে-মুখে আনন্দ চিকচিক করে ওঠে। সেটা ঘটে- আমি কথা বলেছি 
বলে। কিন্তু তুমি জানো না- সেটা হয়তো আমার কাছে শুধু মাত্র ‘শব্দ’ই। কখনো কখনো কেউ কোন শব্দ বেশী উচ্চারণ করলে
আমার মস্তিষ্ক সেটা রিপিট করতে পারে। তুমি তাকে কথা মনে করতেই পার। এমন অনেক শব্দই আমার কাছে আছে। কখনো 
কখনো তিন চারটি শব্দও আমি পুনরাবৃত্তি করতে পারি। তবে এমনও হয়েছে বেশ অনেকবার– যেমন রান্নাঘরের সাথে যে রুম, 
সে’ রুমের আলমিরাতে কিছু একটা খুঁজছি। আমার মা আমাকে খুঁজতে সাহায্য করছে। কিন্তু আলমিরার কোথাও সেটা নেই। 
আমার মা হয়তো আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে- জিনিষটি এখানে নেই। কিন্তু- তার কথা তখন, আমার কাছে সঠিক মনে 
হয়না। আমি মরিয়া হয়ে খুঁজতেই থাকি। শেষ পর্যন্ত না-পেলে, তীব্র রাগ এসে আমাকে গ্রাস করে। আমি একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে
“দীপু পাপা” বলে চিৎকার করতে করতে তার কাছে ছুঁটে যাই। অর্থাৎ আমি তার সাহায্য চাই। এটা হয়তো শব্দের সঠিক 
প্রয়োগ। কিন্তু এটা কী কথা? আসলে এটা যতটা না কথা তার চে’ বেশী- শব্দের পরে শব্দ পুনরাবৃত্তি করা। আমাকে যদি 
বলা হয় “নাফি এখন ভাত খাবে। এসো।” শব্দগুলোর প্রয়োগ-ক্ষেত্র মনে রেখে পরবর্তীতে আমার প্রয়োজনে হয়তো মাকে বলতে 
পারি- “নাফি ভাত খাবে।” কিন্তু সেটা যে বলতে পারবো – তেমন নাও হতে পারে। আবার এমনিতেই বারবারই বলতে পারি 
– “নাফি ভাত খাবে।” সেটা কিন্তু শব্দগুলোকে মুখস্ত করার জন্যে নয়, বরং হতে পারে “শব্দগুলো বেশ আকর্ষণীয় কিংবা 
প্রয়োজনীয় বলেই আমার মস্তিষ্ক সেটা রিপিট করে যাচ্ছে! আমার মতো এ’রকম- প্রত্যেকেরই একাধিক বৈচিত্রময় বৈশিষ্ট্য থাকতে 
পারে। আর সে’কারণেই বলা হয় যে- “যদি তুমি অটিজম আছে এমন একজনকেও দেখে থাক, তাহলে তুমি একজনকেই 
দেখেছ।” অর্থাৎ সেটা দিয়ে কখনোই অটিজমকে বোঝা যায় না। আমাদের প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য, এমন কি ভিন্ন মাত্রার 
অটিজম আছে। তবে বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয়ে মিল নিশ্চয়ই আছে। যেমন আমরা প্রত্যেকেই একটা সিকোয়েন্স অনুসরণ 
করে চলতে পছন্দ করি- যেটা আমি আগেও বলেছি। আমাদের প্রত্যেকেরই এক বা একাধিক ইন্দ্রিয়গত স্পর্শকাতরতা থাকতে পারে।
পৃথিবীকে আমরা ভিন্ন একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি- যেটাকে তুমি কোনভাবেই ভুল বলতে পার না। হতে পারে- স্পর্শানুভূতিকে 
প্রগাঢ়তরভাবে অনুভব করা, শব্দকে উচ্চতরভাবে শুনতে পাওয়া, ঘ্রাণকে গভীরভাবে পাওয়া কিংবা কোন কিছুকে স্পষ্টতরভাবে
দেখা- এই বৈশিষ্ট্যেগুলোতে বেশ মিল আছে। এ’ছাড়া রকিং- মানে দোল খাওয়া কিংবা স্পিনিং- অর্থাৎ এক জায়গায় ঘুরতে
থাকা এটাও অনেকটা কমন বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই পড়ে। যেমন আমি বিছানায় কিংবা চেয়ারে বসে রকিং পছন্দ করি। আসলে 
তোমাদের উচিত আমরা কী পারছি-না সেটা নয়, বরং কী পারছি, কিভাবে পারছি সেটার দিকে লক্ষ্য করা এবং সেটা করতে
আমাদেরকে সাহায্য করা। 
 
তিন।। 
অটিজম আমাকে কোথাও কোথাও হয়তো কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়। তেমনি কোন 
কোন ক্ষেত্রে আবার বেরও করে আনে- অনেক সমস্যার সহজ-সমাধান করে দেয়। এবং সেটা ঘটে অনেকটাই শক্তিশালী চুম্বকের
আর্কষণ অথবা বিকর্ষণ শক্তির মতো করে। এটা কখনো হয়তো আমাকে তীব্র আঘাত করে আবার কোথাও আমাকে স্বাভাবিকের 
চাইতেও বেশী শক্তি জোগায়। আর- তুমি যখন কোন বস্তুর (object) দিকে তাকাও তখন তুমি প্রথমে সেটার পুরোটা দেখ 
এবং এরপরই তুমি ধাপে ধাপে তার বিস্তারিত (details) দেখতে পাও। কিন্তু যার অটিজম আছে সে প্রথমেই বিস্তারিতের 
মধ্যে লাফ দিয়ে পড়ে। তারপর ধাপে ধাপে সম্পূর্নটা দেখতে পায়। 

চার।।
সমাজ বা পৃথিবী আমাকে কিভাবে দেখে বা আমাকে কেমন দেখায়- আমি সেটা গ্রাহ্য করি না। ভয়ডরহীনভাবে আমি সেটাই 
করি যা আমি করতে চাই। তোমার মনে হতে পারে অটিজম আছে এমন শিশুর- তার বিশেষ চাওয়াগুলো নিয়ে বেড়ে উঠা 
সত্যি খুব বাজে ব্যাপার। কিন্তু আমি বলবো সবচে’ বাজে ব্যাপার হলো আমার বিশেষ চাওয়াগুলোর প্রতি তোমাদের খেয়াল 
কিংবা গ্রাহ্য না-করা। আসলে বাইরে থেকে আমাকে দেখে তোমরা যেমন বুঝবে না, তেমন- আমার ভিতর থেকে বাইরে 
তাকিয়েও তোমার মনে হতে পারে –এর কোন ব্যাখ্যা নেই। এটা আসলে- অনেকটাই কম্পিউটারের ভিন্ন অপারেটিং সিস্টেমের
মত। আর কোন কারণে প্রকৃতি সেটা আমার ভিতরে আপলোড করে দিয়েছে। আমি ছাড়া আর কেউ সেই অপারেটিং সিস্টেম
 জানে না। আর সেটাই আমার জীবনের অংশ।  (চলবে)

“I know of nobody who is purely autistic, or purely neuro-typical. Even God has 
some autistic moments, which is why the planets spin.” 
  
-Jerry Newport, 
Author of “Your Life is Not a Label” 
 
জেরী নিউপোর্ট, (জন্ম আগষ্ট ১৯, ১৯৪৮) এর ৪৭ বৎসর বয়সে তার এসপারজার এর উপসর্গ/উচ্চ ক্রিয়াশীল অটিজম ধরা
পড়ে। এবং এই সময়েই তিনি এই বইটি লিখেন। বইটি মূলতঃ অক্ষম মানুষদেরকে গভীরভাবে সম্পৃক্ত করে লেখা। নিজের সাফল্য 
এবং ব্যর্থতা নিয়ে এই বইয়ে তিনি অনেক খোলামেলা কথাবার্তা বলেছেন। জেরী যে কোন বক্তৃতা বা উপস্থাপনার সময়েও অকপটে
 উপদেশ যেমন দিতেন, তেমনি রসিকতাও করতেন প্রচুর। তিনি মিসিগান ইউনিভার্সিটি থেকে অংক শাস্ত্রে স্নাতক সম্পন্ন করেন। 
অংকে তাকে একজন পন্ডিত বলা হয় এবং মুখে মুখে তিনি অনেক জটিল অংক করতে পারতেন। জেরী ২০১০ সালের Mental 
Calculation World Cup in Magdeburg, Germany -তে তিনি অংশগ্রহন করেন। ১০টি ইভেন্টের মধ্যে ৪টিতে 
জয় লাভ করেন। এখানে তিনি ১টিতে ২য়, একটিতে ৩য় এবং World Cup Trophy for "Most Versatile 
Calculator." পদক জয় লাভ করেন। মজার ব্যাপার হলো তার ৪৬তম জন্মদিনে জেরী বিখ্যাত টিভি সিরিজ 
‘ষ্টার ট্রেক’ এর অভিনেত্রী মেরী লুইসকে বিয়ে করেন। জেরী নিউপোর্টের সবচে’ উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- তিনি হলিউডের 
একজন বিখ্যাত screenwriter হিসাবে সাফল্য লাভ করেন। তার লেখা- পল (Pal) অনুসারে ১৯৮৮ সালে নির্মিত হয় 
অটিজমের উপরে এ’যাবৎ কালের সবচে’ বিখ্যাত ছবি “Rain Man”। বলা বাহুল্য, এটি একটি অস্কার জয়ী ছবি। এতে 
ডাস্টিন হফম্যানের মত বিখ্যাত অভিনেতা অটিষ্টিক মানুষের চরিত্রে অভিনয় করেন। টম ক্রুজ এ’ছবিতে তার ভাইয়ের ভূমিকায় 
অভিনয় করেন। অনেক বছর আগে, ছবিটি আমি কয়েকবার দেখেছি। ভাল লেগেছে। ছবিটির লিন্ক নিচে দিয়ে দিয়েছি। 
এ’ছাড়া জেরী নিউপোর্টের বিখ্যাত বই “Your Life is Not a Label” –এর ই-বুকের লিন্কও দিয়েছি। যে কেউ 
চাইলে বইটি পড়ে নিতে পারেন। স্বাভাবিকভাবেই, বইটি ইংরেজীতে লেখা। 


৯ম পর্বঃ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা-(২)

My brain is different but the thoughts and emotions in it is as real, as valid, as beautiful and as important as anyone’s.
তিন।।
অটিষ্টিক মানুষদের একটা বড় ধরনের সমস্যা হলো স্থান পরিবর্তন করা। আমরা তাই সহজে বাসা পরিবর্তন করতে চাই না। কিন্তু বাসা বদল করলে বেশ কয়েকদিন নাফিকে নিয়ে আমাদের কষ্ট করতে হয়। তার ধারণা হয়- আমাদের নিশ্চয়ই বিরাট কোন ভুল হচ্ছে। এটা আমাদের বাসা না। আমাদের বাসা তো ঐখানে। এবং আমাদের সেই ভুল এতটাই বড় ভুল যা কিনা তার পৃথিবীটাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে। ফলে সে স্কুল কিংবা বাইরে থেকে ফিরে আগের বাসায় যাওয়ার জন্যে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করে। অটিষ্টিক মানুষরা চায় একটা স্থির এবং নিরাপদ জগৎ। সহজাতভাবে পাওয়া ‍শক্তিশালী illusion দিয়ে তিলতিল করে গড়ে তোলা পৃথিবীটা ভেঙ্গে যাওয়া- তার কাছে অনেক বেশী কষ্টের। অনেক বেশী অনিরাপদ। নিত্য ব্যবহৃত বস্তুর প্রতিও ওদের এই একই অনুভূতি সক্রিয় থাকে।
সাম্প্রতিক যে সমস্যাটা আমাদের ভীষণ বিব্রত করছে তাহলো- নাফি ইদানিং আনন্দ করার সময়ে- চিৎকার করতে-করতে, স্কিপিং করার মত ক্রমাগত ৪/৫টা লাফ দেয়। এ’সময়ে লাফ দিয়ে সে মেঝে থেকে প্রায় থেকে ৬-৮ ইঞ্চি মত উঁচুতে উঠে যেতে পারে। প্রতিবার ল্যান্ডিংয়ের পর তার ১৪০ পাউন্ড ওজনের শরীরটা মেঝেতে যে শব্দ তৈরী করে সেটা নিচের তলার ভাড়াটিয়ারা সহ্য করতে রাজি না। নাফি বেচারা জানে না তার আনন্দ করার এই ধরণ সমাজের মানুষগুলো মানতে রাজি না। মনে হয় পৃথিবীটা শুধু তাদের জন্যে- যারা autism friendly পৃথিবী কোনভাবেই মানতে কিংবা নাফিকে দিতে রাজি নয়। আমার বাড়িওয়ালা যেমন মানুষই হোক দীর্ঘ প্রায় ৮টি বৎসর সে নানা রকমের যন্ত্রনার পরেও নাফির প্রতি সহানুভূতিশীল। সম্প্রতি তার ছোট বোন এসে উঠেছে ঠিক আমাদের সোজা নিচে- দোতলায়। আমরা তিন তলায়। এখন প্রতিদিন ২/৩ বার এমন শব্দের ঘটনা নাকি তাদের বিল্ডিংয়ে ফাটল ধরিয়ে দিচ্ছে। ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। তাদের বাচ্চা ভয় পাচ্ছে। সবচে’ বড় সমস্যা তিনি বলছেন- নাফির চিল্লানিতে তার ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়!! অথচ তার আরেক ভাই যখন নিচে প্রাইভেট কার দাঁড় করিয়ে প্রচন্ড হাই ভলিউমে বিদঘুটে এবং বোধগম্যহীন ইংলিশ মিউজিক শোনে- তাতে তার কোন অভিযোগ থাকে না। অথচ তখন আশেপাশের সমস্ত বিল্ডিং-ই সেই শব্দে কাঁপতে থাকে। ইনিয়ে বিনিয়ে, তিলকে তাল বানিয়ে বাসা ছাড়তে হবে সেটা আমাদেরকে নানাভাবে বোঝানো হয়ে গেছে। কিন্তু আমি বাসা ছেড়ে যাব কোথায়? তাই বাড়িওয়ালাকে কে বললাম- “এই পাড়ায় নাফির জন্ম। এখানে সে ১৮টা বছর কাটিয়েছে। কেউ কোনদিন ওর নামে কোন অভিযোগ করেনি। আর আপনার বোন নতুন এসেই আপনাকে এবং আমাদেরকে বোঝাতে শুরু করেছেন – নাফির লাফে বিল্ডিং ফেটে যাচ্ছে। উনি যে মিথ্যা কথা বলছেন- এটা আমি বুঝি। উনি একজন মিথ্যুক এবং অমানবিক। বিল্ডিং যদি ফেটেই থাকে সেটা অন্য কোন কারণে হতে পারে। নাফির লাফে বিল্ডিং ফাটতে পারে না।” বাড়িওয়ালা কিছুই বললেন না আমার কথা শুনে। শেষে কোন উপায় না করতে পেরে নতুন কৌশল নিয়ে এলেন তারা। ভাড়া ৫০০/১০০০ -এর জায়গায় এক লাফে ২০০০ বাড়িয়ে দিলেন। আমিও জানিয়ে দিলাম- ‘আইন অনুযায়ী ভাড়া বাড়াতে হবে। যেমন খুশি বাড়ালে হবে না।’ বাড়িভাড়া আইন এর বিস্তারিত হাতের কাছে রেখে দিয়ে জুন মাসের যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছি। প্রয়োজনে আইনের দ্বারস্থ হবো। জানি তাদের হাত অনেক লম্বা। গায়ে অনেক শক্তি। কিন্তু তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। বাড়িওয়ালা না-আমাদের পক্ষে, না-তার বোনের পক্ষে। তার বোন বাড়িওয়ালার বউকে সাথে নিয়ে কলকাঠি নাড়ছে। যাইহোক, উল্টাপাল্টা ভাড়া বাড়িয়ে তারা ঠিক করেনি। এটা তাদের একটা খুব বাজে রকমের ভুল বুদ্ধি।
চার।।
আজ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমি জানি বেঁচে থাকার জন্যে পরিবারের বাকী সবার পরবর্তী সিকোয়েন্সগুলো কী হবে। জয়ী এবং নাফির জন্যে বেঁচে থাকার একটা ক্ষেত্র কোথাও-না-কোথাও ঠিকই তৈরী করবে তাদের মা। তবে প্রথমেই বাসা ছাড়তে হবে। তারপরে কী হবে সেটা আপনাদের নাইবা বললাম। কিন্তু আমার পরে তার মায়ের মৃত্যু হলে নাফির বেঁচে থাকার ক্ষেত্র তখনও ‍তৈরী হবে। তবে সেটা হবে মরতে মরতে বেঁচে থাকার মতই। কারণ ক্ষুধার জ্বালায় কোন হোটেলে খাবার দেখেও তো সে চাইতে জানে না। চাইতে হলে একজন মানুষের হাতটা আলগোছে ধরে। তারপর তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর কাঙ্খিত খাদ্য বা বস্তুর দিকে সেই ধরে থাকা হাতকে পৌঁছে দেয়- মানে আমাকে এটা দাও। তার চোখের দিকে তাকিয়ে কে বুঝবে গভীরে থাকা আবেদনটুকু। কে দেবে তাকে তার পছন্দমত খাবার? কে বুঝবে তার ত্বক কিংবা শব্দজনিত স্পর্শকতরতা? কে বুঝবে তার একটা নির্দিষ্ট-নিরাপদ পৃথিবী ছাড়া সে কোনভাবেই বাঁচবে না।
এটা সত্যি পৃথিবী কারো জন্যে থেমে থাকে না। আমার আগেও কোটি কোটি মানুষ মারা গেছে। আমার পরেও যাবে। তাতে পৃথিবীর কিছু এসে যায় না। এমন কি নাফি কষ্ট পেয়েও মারা গেলেও পৃথিবীর কিছু এসে যাবে না। তখনও পৃথিবী চলতে থাকবে আগের মতই। তার নিয়মে। হ্যাঁ আমিও জানি এটাই নির্মম সত্যি। কিন্তু মানুষ আমি- তাই কোনভাবেই পৃথিবীর বুকে নাফির কষ্ট মানতে পারবো না। অমানবিকতা, অশিক্ষা আর স্বার্থপরতা- এমন সব বৈশিষ্টের মানুষ দিয়ে ভরা এই সমাজ। ঠিক তার ভিতরেই একটা Autism friendly সমাজ তৈরী কতটা কঠিন সেটা আমি ভালই জানি। আমার কেবলই মনে হয়- সব ছাপিয়ে আমার আত্মাও বোধ হয় নাফির পিছনে পিছনে ঘুরবে- শুধু তার স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্যে। মাঝে মাঝে মনে হয় নাফিকে দেখাশোনার জন্যে সৃষ্টিকর্তা বোধ হয় জয়ীকে সৃষ্টি করেছেন। হয়তো সে কারণে জয়ী সে’রকম সক্ষমতাও একদিন অর্জন করবে। সে এখন মাত্র ক্লাস থ্রীতে পড়ে। জীবনের জটিলতার কিছুই এখনও বোঝেনা। তাছাড়া আমার এ’ধারণা ভুলও হতে পারে!
নাফির জন্যে জয়ীর কথা ভাবতেই আমার ভাবনাগুলো আরো গভীরে ছুটে চলতে থাকে। স্তরের পর স্তর ভেদ করে- আরো গভীরে। জাগতিক ভাবনা পেরিয়ে পৌঁছে যায় অতিজাগতিক ভাবনায়। নির্বোধের মত আমি বুঝতে চাই –এই মহাজগতের সেই আর্কিটেক্চার আমাদের জন্যে তার ডিজাইনটা ঠিক কিভাবে দাঁড় করিয়েছেন! কিন্তু বরাবরের মত আমার জন্যে সেখানে বিষম এক অন্ধকার অপেক্ষা করতে থাকে। আর আমি মানুষ বলেই বোধ হয়, চিরন্তন সেই আক্ষেপ সত্ত্বেও ভাবি- হায়! আমি যদি ফেইট নামের সেই আশ্চর্য ডিজাইনটা কোনভাবে আগেভাগে দেখতে পেতাম! আমার আক্ষেপ প্রতিধ্বনি হয়ে বারবার ফিরে আসে আমার কাছে। আমি আর ভাবতে পারি না। নিজেকে বেশ কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো মনে হয়। হঠাৎ করেই তখন চেতনাবিহীন এই সমাজ আর সেখানে পদচারণারত অধিকাংশ অকর্ষিত মানুষের বোধ-বুদ্ধি-আচরণ আমার কাঁধে বিষম ভারী কোন বোঝার মত মনে হতে থাকে! (চলবে)

৮ম পর্বঃ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা-(১)

“You can’t punish a child who is acting out because of sensory overload.”
-Dr. Temple Grandin (The writer of “The Autistic Brain”)
এক।।
একটা অটিজম-বান্ধব সমাজ নাফির জন্যে নিশ্চয়ই বিশাল কিছু। বর্তমান সমাজে অটিজম সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানে। আমি অনেক ডাক্তারকে পেয়েছি যারা অটিজম শব্দটাই শোনেননি। তার মধ্যে শেষের জনের কথা বলি। ৮/৯ মাস আগের কথা। মশার কামড়ে নাফি তার দুই পায়ের পাতা চুলকিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলতো। সে নিজে মশারী ব্যবহার করে না এবং কাউকে করতেও দেয় না। আমরা মলম লাগিয়ে ঘা শুকানোর অপেক্ষায় থাকতাম। কিন্তু ঘা শুকানোর সময়ে যখন ত্বকে টান পড়ে, তখন সে তীব্র চুলকানি বোধ করতো, ফলে আবারো সেখানে চুলকিয়ে সেই ঘাকে কাঁচা বানিয়ে ফেলতো। কোনভাবেই শুকানো পর্যন্ত পৌঁছুতে পারছিলাম না। এখানে বোঝার বিষয়টা হলো- আপনি কোথাও চুলাকোনোর জন্যে যে অনুভূতি সাধারণভাবে অনুভব করেন, নাফি সেই অনুভূতি অনেক গুণ বেশী অনুভব করে- শুধুমাত্র তার জন্মগতভাবে পাওয়া স্পর্শকাতর ত্বকের কারণে। একটা সময়ে এমন হলো যে আঁড়ালেই সে দুই পা রক্তাক্ত করে চুপচাপ শুয়ে থাকতো। রক্তের ধারা দুই পা বেয়ে নেমে চাদর, কোল বালিশ সব রক্তাক্ত করে দিতো। কয়েকমাস পেরিয়ে গেলেও এই সমস্যার সমাধান যখন করতে পারছিলাম না তখন ধানমন্ডির কমফোর্ট হসপিটালে নেয়া হলো। সে’দিন দু’জন ডাক্তারকে দেখাতে হলো। প্রথমজন নিউরোলজিস্ট ডাক্তার। অন্যান্য রোগীদের পাশাপাশি অটিস্টিকদেরও চিকিৎসা করেন। কিন্তু কোন কারণবশতঃ তিনি অটিস্টিকদের ক্ষেত্রে কোন ফি নেন না। অত্যন্ত অমায়িক এই ডাক্তার যেমন প্রচুর প্রশ্ন করেন তেমনি সময় নিয়ে রুগীকেও দেখেন। আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ। দ্বিতীয়জন স্কীন বিশেষজ্ঞ। এই দ্বিতীয়জন অটিজম শব্দটাই শোনেননি! অটিজম কী সেটি বোঝার জন্যে কয়েকটি প্রশ্ন করতে করতে অবাক হয়ে নাফির দিকে তাকালেন কয়েকবার। এরপর দূর থেকে টর্চ জ্বেলে নাফির পা দু’টো দেখলেন একনজর। এরপর প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে আবারও অবাক চোখে নাফিকে দেখে নিলেন কয়েকবার। ব্যস্! তিনি তার ফি-টাও নিলেন মোটা অংকের। অবশ্য তার ঔষধে কাজ হয়েছিল। এটাতো গেল ডাক্তারদের কথা। সাধারণ মানুষদের মধ্যেও খুব কম মানুষই অটিজম সম্পর্কে ধারণা রাখেন।
দুই।।
আমাদের পাড়ায় নাফিকে দেখলে ছোট ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে, যুবক-যুবতী, শক্ত সামর্থ পুরুষ/মহিলা- অনেকেই ভয় পায়। বোধ হয় পাগল-টাগল মনে করে। ভয়ে চিৎকার করে দৌড়ে পালায় এমনও আছে অনেকে। অথচ সে দেখতে একবারেই স্বাভাবিক মানুষের মত। হাঁটা, চলাফেরাও তাই। কাউকে আঘাত করে না। এমনিতেই যারা অটিষ্টিক, তারা বাইরে থেকে দেখতে সাধারন মানুষদের মত হয়। কেউ বলে না দিলে আপনি বুঝবেন না তার অটিজম আছে। নাফি যখন স্কুল থেকে বাসায় ফেরে তখন আমাদের গা-ঘেষাঘেষি করে দাঁড়ানো ৭/৮ টি ফ্লাটের অনেক গৃহিনীদের দেখি দল বেঁধে নিচে আড্ডায় ব্যস্ত থাকেন। অনেকেই যাঁরা আমাদের প্রবেশ পথের কাছাকাছি থাকেন- নাফিকে দেখলেই দৌড়ে পালান। ওদের দেখাদেখি ছোটরাও একই কাজ করে। বীনার খারাপ লাগে। কিন্তু সে বিরক্তি প্রকাশ করে না। আমি রেগে যাই। তাদের উপাধি দেই ছাগল। অনেক সময়ে অনেককে প্রশ্ন করি – “আপনি দৌড় দিলেন কেন?”। আজ পর্যন্ত কাউকে পেলাম না যিনি আমার এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে চেষ্টা করেছেন। প্রশ্ন শুনে প্রতিক্রয়ায়- বেশীর ভাগই হাসেন। কিন্তু উত্তর দেন না। অনেক দুষ্ট ছেলে নাফিকে ভেঙ্গায়। নাফির উচ্চারিত শব্দগুলো বিকৃত করে উচ্চারণ করে। আমার কানে আসে। তখন চট করে মাথায় রক্ত চড়ে যায়! চিৎকার করে এই সমাজটাকে বলতে ইচ্ছে করে- Don’t make this shit. Get off his back! কিন্তু বলতে পারি না। হ্যাঁ, এমন অনেকবার হয়েছে যে ভেঙ্গানোর সাথে সাথে নির্দিষ্ট ছেলেটাকে ধরে ফেলেছি। বেশ শক্ত করে হাত ধরে বলেছি- “কি বললি রে তুই?” কিন্তু ঐ মুহুর্তে আমার চেহারা দেখে সে এতটাই ভয় পেয়ে যায় যে, তোতলাতে থাকে। আমি নিশ্চিত সে আর কোনদিন কিছু বলার সাহস পাবে না। তখন আর কিছু না বলে, ছেড়ে দেই তাকে।
এটা তো গেল বাইরের মানুষের কথা। নাফির খুব কাছের মানুষরাই তো ওকে বোঝে না। ওর আপন মেজ মামা- যে কিনা আমাদের ১০০ মিটারের মধ্যে বাস করে, সেদিন মাত্র নাফির মাকে প্রশ্ন করলো – “ও কানে আংগুল দিয়ে রাখসে কেন?!” ওর মায়ের উল্টো প্রশ্ন – “তুই মামা হয়ে এতদিনে জানিস না কেন?” সে আসলে সৌজন্য রক্ষার্থে প্রশ্ন করতে যেয়ে বিপাকে পড়ে গিয়েছিল! নাফির সাথে ওর চাচা-মামাদের কেউই বলতে গেলে কথা বলে না। খোঁজও রাখে না। ওর কাজিনরাও তাই। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলে সবাই। ব্যতিক্রম দেখেছি ওর বড় মামা এবং ওর একমাত্র খালাতে বোন রিয়ার ক্ষেত্রে। ওরা দেখা হলেই হাসি মুখে হ্যান্ডসেক করে। কথা বলে নাফির সাথে। খোঁজ-খবরও কম-বেশী রাখে। আমার ভাল লাগে। ওর ছোট মামা দেখা হলে, না-বুঝে হলেও কথা বলে নাফির সাথে। ‍কিন্তু খোঁজ নেয় না কখনো। কিন্তু বাকীরা ভয় পায় এবং দৌড়ে পালায়। নাফির ছোট চাচা ওকে অনেক ভালবাসে। তার ভালবাসা কৃতজ্ঞতার সাথে মনে রাখার মত। কিন্তু নাফিকে, বড় হবার পর দেখেছে মাত্র একবার। দূর থেকে খবর রাখে। সহযোগীতা করে। তার মেজো চাচাও বাসায় এসে দেখে গেছে ২ বার। সেটা নাফিকে বোঝার চাইতে সৌজন্যতা রক্ষাই ছিল বড় বিষয়। আমার হাতে গোনা এই ক’জন মানুষ ছাড়া কেউ নেই ওর সাথে কথা বলার মত। দুঃখজনক হলেও সত্যি- যাদের কথা এতক্ষণ বললাম, তারা কেউই কিন্তু বোঝে না ওকে। অটিজম সম্পর্কেও কোন ধারণা নেই তাদের। এমনকি জানার আগ্রহটাও নেই। আরেকটি অত্যন্ত বাজে রকমের ব্যাপার হলো- ওর একমাত্র খালু ওকে দেখা মাত্রই স্পর্শকাতর জায়গায় হাত চালিয়ে খোঁচা মারতে খুবই পছন্দ করে এবং মহামিশুক মানুষদের মত নাফিকে প্রশ্ন করেন- “কী খবর?” তার কোন ধারণাই নেই অটিজম কী কিংবা এতে করে নাফির ঠিক কেমন অনুভূতি হতে পারে। আমার খুব বিশ্রী রকমের রাগ হয়। শুধু আত্মীয় বলে- ঠোঁট কামড়ে সামলে নেই নিজেকে। (চলবে)