Friday, December 7, 2018

১০ম পর্বঃ আমার ভিতরে বাহিরে (আত্মকথাঃ ফারহান আরিফ নাফি)

এক।। 
আমার- কারো কাছে কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। যা কিছু বোঝার- আমি আমার জ্ঞানতঃ বুঝে নেই। তাই কারো কাছে
আমার কোন প্রশ্নও নেই। হ্যাঁ, এটাও সত্যি যে, আমার কোন স্বপ্ন নেই। ভবিষ্যতের কোন স্বপ্ন আমি দেখি না। ‍সত্যি বলতে কী
অটিজম আছে- এমন মানুষগুলোর ভাবনায়- ভবিষ্যৎ কালটাই নেই। শুধু ভবিষ্যৎ কাল কেন, আমরা অতীতকাল নিয়েও 
তোমাদের মত মাথা ঘামাই না। তাই, আমি বেঁচে থাকি শুধু বর্তমান কালকে নিয়ে।  তবে প্রকৃতি আমাকে এমন কিছু পারগতা 
দিয়েছে যার সাহায্যে আমি- তোমার চোখ দিয়ে দেখতে পারি। তোমার অনুভূতিকে হুবহু অনুভব করতে পারি। আমার এই শক্তি 
আমাকে শিখতে সাহায্য করে। এমনকি এটা আমাকে সতর্ক হতেও সাহায্য করে। আমি যখন তোমার দিকে তাকাই, তোমার চোখ 
এবং  ঠোঁটের দিকে আমার তীক্ষ্ণ মনোযোগ থাকে। প্রতিটি শব্দে তোমার প্রতিক্রিয়া আমি মনে রাখি। আমার মস্তিকে তোমার 
অনুভূতির একটা নিখুঁত ছবি তৈরী হয়। এবং সেটা এতটাই নিখুঁত যে- তুমি কল্পনা করেও তা পেতে পার না। তোমার মনে 
হতে পারে আমি ঠিক স্বাভাবিক নই। কিন্তু আমি আমার জন্যে ভীষণভাবেই স্বাভাবিক। 
 
দুই।।
স্কুলে আমার শিক্ষকরা আমাকে শিখতে সাহায্য করে। কিন্তু সেটা যতটা না তাদের মতো করে, তার চে’ বেশী তাঁরা করেন 
সে’ভাবে- যে’ভাবে ঠিক আমি শিখতে পারি। এমন মনে করার কোন কারণ নেই যে অটিজম আছে এমন মানুষগুলো সবাই 
আমার মতো! সে’কারণেই সবার শিক্ষা পদ্ধতিও একই রকমের নয়। বরং আমরা প্রত্যেকেই আলাদা। আমার যেমন- স্পর্শ 
এবং শ্রবণকাতরতা আছে আরেকজনের সেটা নাও থাকতে পারে। কেউ হয়তো ঘূর্ণায়মান বস্তুর প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। 
কেউ হয়তো বিচিত্র কোন কারণে প্রথম দেখা, নতুন মানুষটার মাথার গন্ধ শুঁকে নিতে পছন্দ করে। কেউ হয়তো সবকিছুই 
জিহ্বা দিয়ে অনুভব করতে চায়। সেটা লোহা, কাপড় কিংবা মাটি যাই হোক না-কেন। আমি যেমন কোন কাপড় ভেজা কি-না,
সেটা ঠোঁট দিয়ে অনুভব করি। কেউ হয়তো খুবই শান্ত। আবার কেউ হয়তো হঠাৎ রেগে যায়, এমনকি কাউকে আক্রমণও করে 
বসতে পারে। কেই হয়তো লিখতে পারে,পড়তেও পারে। আবার কেউ শুধু হয়তো এ’দুটির একটিই পারে। হতে পারে- কেউ 
কোনটাই পারে না। কেউ হয়তো কথাও বলতে পারে। কেউ হয়তো পারে না। আমি যেমন কথা বলে উঠি কখনো কখনো। 
আমি কথা বলার পর খেয়াল করে দেখি বাসার সবার চোখে-মুখে আনন্দ চিকচিক করে ওঠে। সেটা ঘটে- আমি কথা বলেছি 
বলে। কিন্তু তুমি জানো না- সেটা হয়তো আমার কাছে শুধু মাত্র ‘শব্দ’ই। কখনো কখনো কেউ কোন শব্দ বেশী উচ্চারণ করলে
আমার মস্তিষ্ক সেটা রিপিট করতে পারে। তুমি তাকে কথা মনে করতেই পার। এমন অনেক শব্দই আমার কাছে আছে। কখনো 
কখনো তিন চারটি শব্দও আমি পুনরাবৃত্তি করতে পারি। তবে এমনও হয়েছে বেশ অনেকবার– যেমন রান্নাঘরের সাথে যে রুম, 
সে’ রুমের আলমিরাতে কিছু একটা খুঁজছি। আমার মা আমাকে খুঁজতে সাহায্য করছে। কিন্তু আলমিরার কোথাও সেটা নেই। 
আমার মা হয়তো আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে- জিনিষটি এখানে নেই। কিন্তু- তার কথা তখন, আমার কাছে সঠিক মনে 
হয়না। আমি মরিয়া হয়ে খুঁজতেই থাকি। শেষ পর্যন্ত না-পেলে, তীব্র রাগ এসে আমাকে গ্রাস করে। আমি একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে
“দীপু পাপা” বলে চিৎকার করতে করতে তার কাছে ছুঁটে যাই। অর্থাৎ আমি তার সাহায্য চাই। এটা হয়তো শব্দের সঠিক 
প্রয়োগ। কিন্তু এটা কী কথা? আসলে এটা যতটা না কথা তার চে’ বেশী- শব্দের পরে শব্দ পুনরাবৃত্তি করা। আমাকে যদি 
বলা হয় “নাফি এখন ভাত খাবে। এসো।” শব্দগুলোর প্রয়োগ-ক্ষেত্র মনে রেখে পরবর্তীতে আমার প্রয়োজনে হয়তো মাকে বলতে 
পারি- “নাফি ভাত খাবে।” কিন্তু সেটা যে বলতে পারবো – তেমন নাও হতে পারে। আবার এমনিতেই বারবারই বলতে পারি 
– “নাফি ভাত খাবে।” সেটা কিন্তু শব্দগুলোকে মুখস্ত করার জন্যে নয়, বরং হতে পারে “শব্দগুলো বেশ আকর্ষণীয় কিংবা 
প্রয়োজনীয় বলেই আমার মস্তিষ্ক সেটা রিপিট করে যাচ্ছে! আমার মতো এ’রকম- প্রত্যেকেরই একাধিক বৈচিত্রময় বৈশিষ্ট্য থাকতে 
পারে। আর সে’কারণেই বলা হয় যে- “যদি তুমি অটিজম আছে এমন একজনকেও দেখে থাক, তাহলে তুমি একজনকেই 
দেখেছ।” অর্থাৎ সেটা দিয়ে কখনোই অটিজমকে বোঝা যায় না। আমাদের প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য, এমন কি ভিন্ন মাত্রার 
অটিজম আছে। তবে বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয়ে মিল নিশ্চয়ই আছে। যেমন আমরা প্রত্যেকেই একটা সিকোয়েন্স অনুসরণ 
করে চলতে পছন্দ করি- যেটা আমি আগেও বলেছি। আমাদের প্রত্যেকেরই এক বা একাধিক ইন্দ্রিয়গত স্পর্শকাতরতা থাকতে পারে।
পৃথিবীকে আমরা ভিন্ন একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি- যেটাকে তুমি কোনভাবেই ভুল বলতে পার না। হতে পারে- স্পর্শানুভূতিকে 
প্রগাঢ়তরভাবে অনুভব করা, শব্দকে উচ্চতরভাবে শুনতে পাওয়া, ঘ্রাণকে গভীরভাবে পাওয়া কিংবা কোন কিছুকে স্পষ্টতরভাবে
দেখা- এই বৈশিষ্ট্যেগুলোতে বেশ মিল আছে। এ’ছাড়া রকিং- মানে দোল খাওয়া কিংবা স্পিনিং- অর্থাৎ এক জায়গায় ঘুরতে
থাকা এটাও অনেকটা কমন বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই পড়ে। যেমন আমি বিছানায় কিংবা চেয়ারে বসে রকিং পছন্দ করি। আসলে 
তোমাদের উচিত আমরা কী পারছি-না সেটা নয়, বরং কী পারছি, কিভাবে পারছি সেটার দিকে লক্ষ্য করা এবং সেটা করতে
আমাদেরকে সাহায্য করা। 
 
তিন।। 
অটিজম আমাকে কোথাও কোথাও হয়তো কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়। তেমনি কোন 
কোন ক্ষেত্রে আবার বেরও করে আনে- অনেক সমস্যার সহজ-সমাধান করে দেয়। এবং সেটা ঘটে অনেকটাই শক্তিশালী চুম্বকের
আর্কষণ অথবা বিকর্ষণ শক্তির মতো করে। এটা কখনো হয়তো আমাকে তীব্র আঘাত করে আবার কোথাও আমাকে স্বাভাবিকের 
চাইতেও বেশী শক্তি জোগায়। আর- তুমি যখন কোন বস্তুর (object) দিকে তাকাও তখন তুমি প্রথমে সেটার পুরোটা দেখ 
এবং এরপরই তুমি ধাপে ধাপে তার বিস্তারিত (details) দেখতে পাও। কিন্তু যার অটিজম আছে সে প্রথমেই বিস্তারিতের 
মধ্যে লাফ দিয়ে পড়ে। তারপর ধাপে ধাপে সম্পূর্নটা দেখতে পায়। 

চার।।
সমাজ বা পৃথিবী আমাকে কিভাবে দেখে বা আমাকে কেমন দেখায়- আমি সেটা গ্রাহ্য করি না। ভয়ডরহীনভাবে আমি সেটাই 
করি যা আমি করতে চাই। তোমার মনে হতে পারে অটিজম আছে এমন শিশুর- তার বিশেষ চাওয়াগুলো নিয়ে বেড়ে উঠা 
সত্যি খুব বাজে ব্যাপার। কিন্তু আমি বলবো সবচে’ বাজে ব্যাপার হলো আমার বিশেষ চাওয়াগুলোর প্রতি তোমাদের খেয়াল 
কিংবা গ্রাহ্য না-করা। আসলে বাইরে থেকে আমাকে দেখে তোমরা যেমন বুঝবে না, তেমন- আমার ভিতর থেকে বাইরে 
তাকিয়েও তোমার মনে হতে পারে –এর কোন ব্যাখ্যা নেই। এটা আসলে- অনেকটাই কম্পিউটারের ভিন্ন অপারেটিং সিস্টেমের
মত। আর কোন কারণে প্রকৃতি সেটা আমার ভিতরে আপলোড করে দিয়েছে। আমি ছাড়া আর কেউ সেই অপারেটিং সিস্টেম
 জানে না। আর সেটাই আমার জীবনের অংশ।  (চলবে)

“I know of nobody who is purely autistic, or purely neuro-typical. Even God has 
some autistic moments, which is why the planets spin.” 
  
-Jerry Newport, 
Author of “Your Life is Not a Label” 
 
জেরী নিউপোর্ট, (জন্ম আগষ্ট ১৯, ১৯৪৮) এর ৪৭ বৎসর বয়সে তার এসপারজার এর উপসর্গ/উচ্চ ক্রিয়াশীল অটিজম ধরা
পড়ে। এবং এই সময়েই তিনি এই বইটি লিখেন। বইটি মূলতঃ অক্ষম মানুষদেরকে গভীরভাবে সম্পৃক্ত করে লেখা। নিজের সাফল্য 
এবং ব্যর্থতা নিয়ে এই বইয়ে তিনি অনেক খোলামেলা কথাবার্তা বলেছেন। জেরী যে কোন বক্তৃতা বা উপস্থাপনার সময়েও অকপটে
 উপদেশ যেমন দিতেন, তেমনি রসিকতাও করতেন প্রচুর। তিনি মিসিগান ইউনিভার্সিটি থেকে অংক শাস্ত্রে স্নাতক সম্পন্ন করেন। 
অংকে তাকে একজন পন্ডিত বলা হয় এবং মুখে মুখে তিনি অনেক জটিল অংক করতে পারতেন। জেরী ২০১০ সালের Mental 
Calculation World Cup in Magdeburg, Germany -তে তিনি অংশগ্রহন করেন। ১০টি ইভেন্টের মধ্যে ৪টিতে 
জয় লাভ করেন। এখানে তিনি ১টিতে ২য়, একটিতে ৩য় এবং World Cup Trophy for "Most Versatile 
Calculator." পদক জয় লাভ করেন। মজার ব্যাপার হলো তার ৪৬তম জন্মদিনে জেরী বিখ্যাত টিভি সিরিজ 
‘ষ্টার ট্রেক’ এর অভিনেত্রী মেরী লুইসকে বিয়ে করেন। জেরী নিউপোর্টের সবচে’ উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- তিনি হলিউডের 
একজন বিখ্যাত screenwriter হিসাবে সাফল্য লাভ করেন। তার লেখা- পল (Pal) অনুসারে ১৯৮৮ সালে নির্মিত হয় 
অটিজমের উপরে এ’যাবৎ কালের সবচে’ বিখ্যাত ছবি “Rain Man”। বলা বাহুল্য, এটি একটি অস্কার জয়ী ছবি। এতে 
ডাস্টিন হফম্যানের মত বিখ্যাত অভিনেতা অটিষ্টিক মানুষের চরিত্রে অভিনয় করেন। টম ক্রুজ এ’ছবিতে তার ভাইয়ের ভূমিকায় 
অভিনয় করেন। অনেক বছর আগে, ছবিটি আমি কয়েকবার দেখেছি। ভাল লেগেছে। ছবিটির লিন্ক নিচে দিয়ে দিয়েছি। 
এ’ছাড়া জেরী নিউপোর্টের বিখ্যাত বই “Your Life is Not a Label” –এর ই-বুকের লিন্কও দিয়েছি। যে কেউ 
চাইলে বইটি পড়ে নিতে পারেন। স্বাভাবিকভাবেই, বইটি ইংরেজীতে লেখা। 


No comments:

Post a Comment