Friday, December 7, 2018

৮ম পর্বঃ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা-(১)

“You can’t punish a child who is acting out because of sensory overload.”
-Dr. Temple Grandin (The writer of “The Autistic Brain”)
এক।।
একটা অটিজম-বান্ধব সমাজ নাফির জন্যে নিশ্চয়ই বিশাল কিছু। বর্তমান সমাজে অটিজম সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানে। আমি অনেক ডাক্তারকে পেয়েছি যারা অটিজম শব্দটাই শোনেননি। তার মধ্যে শেষের জনের কথা বলি। ৮/৯ মাস আগের কথা। মশার কামড়ে নাফি তার দুই পায়ের পাতা চুলকিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলতো। সে নিজে মশারী ব্যবহার করে না এবং কাউকে করতেও দেয় না। আমরা মলম লাগিয়ে ঘা শুকানোর অপেক্ষায় থাকতাম। কিন্তু ঘা শুকানোর সময়ে যখন ত্বকে টান পড়ে, তখন সে তীব্র চুলকানি বোধ করতো, ফলে আবারো সেখানে চুলকিয়ে সেই ঘাকে কাঁচা বানিয়ে ফেলতো। কোনভাবেই শুকানো পর্যন্ত পৌঁছুতে পারছিলাম না। এখানে বোঝার বিষয়টা হলো- আপনি কোথাও চুলাকোনোর জন্যে যে অনুভূতি সাধারণভাবে অনুভব করেন, নাফি সেই অনুভূতি অনেক গুণ বেশী অনুভব করে- শুধুমাত্র তার জন্মগতভাবে পাওয়া স্পর্শকাতর ত্বকের কারণে। একটা সময়ে এমন হলো যে আঁড়ালেই সে দুই পা রক্তাক্ত করে চুপচাপ শুয়ে থাকতো। রক্তের ধারা দুই পা বেয়ে নেমে চাদর, কোল বালিশ সব রক্তাক্ত করে দিতো। কয়েকমাস পেরিয়ে গেলেও এই সমস্যার সমাধান যখন করতে পারছিলাম না তখন ধানমন্ডির কমফোর্ট হসপিটালে নেয়া হলো। সে’দিন দু’জন ডাক্তারকে দেখাতে হলো। প্রথমজন নিউরোলজিস্ট ডাক্তার। অন্যান্য রোগীদের পাশাপাশি অটিস্টিকদেরও চিকিৎসা করেন। কিন্তু কোন কারণবশতঃ তিনি অটিস্টিকদের ক্ষেত্রে কোন ফি নেন না। অত্যন্ত অমায়িক এই ডাক্তার যেমন প্রচুর প্রশ্ন করেন তেমনি সময় নিয়ে রুগীকেও দেখেন। আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ। দ্বিতীয়জন স্কীন বিশেষজ্ঞ। এই দ্বিতীয়জন অটিজম শব্দটাই শোনেননি! অটিজম কী সেটি বোঝার জন্যে কয়েকটি প্রশ্ন করতে করতে অবাক হয়ে নাফির দিকে তাকালেন কয়েকবার। এরপর দূর থেকে টর্চ জ্বেলে নাফির পা দু’টো দেখলেন একনজর। এরপর প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে আবারও অবাক চোখে নাফিকে দেখে নিলেন কয়েকবার। ব্যস্! তিনি তার ফি-টাও নিলেন মোটা অংকের। অবশ্য তার ঔষধে কাজ হয়েছিল। এটাতো গেল ডাক্তারদের কথা। সাধারণ মানুষদের মধ্যেও খুব কম মানুষই অটিজম সম্পর্কে ধারণা রাখেন।
দুই।।
আমাদের পাড়ায় নাফিকে দেখলে ছোট ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে, যুবক-যুবতী, শক্ত সামর্থ পুরুষ/মহিলা- অনেকেই ভয় পায়। বোধ হয় পাগল-টাগল মনে করে। ভয়ে চিৎকার করে দৌড়ে পালায় এমনও আছে অনেকে। অথচ সে দেখতে একবারেই স্বাভাবিক মানুষের মত। হাঁটা, চলাফেরাও তাই। কাউকে আঘাত করে না। এমনিতেই যারা অটিষ্টিক, তারা বাইরে থেকে দেখতে সাধারন মানুষদের মত হয়। কেউ বলে না দিলে আপনি বুঝবেন না তার অটিজম আছে। নাফি যখন স্কুল থেকে বাসায় ফেরে তখন আমাদের গা-ঘেষাঘেষি করে দাঁড়ানো ৭/৮ টি ফ্লাটের অনেক গৃহিনীদের দেখি দল বেঁধে নিচে আড্ডায় ব্যস্ত থাকেন। অনেকেই যাঁরা আমাদের প্রবেশ পথের কাছাকাছি থাকেন- নাফিকে দেখলেই দৌড়ে পালান। ওদের দেখাদেখি ছোটরাও একই কাজ করে। বীনার খারাপ লাগে। কিন্তু সে বিরক্তি প্রকাশ করে না। আমি রেগে যাই। তাদের উপাধি দেই ছাগল। অনেক সময়ে অনেককে প্রশ্ন করি – “আপনি দৌড় দিলেন কেন?”। আজ পর্যন্ত কাউকে পেলাম না যিনি আমার এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে চেষ্টা করেছেন। প্রশ্ন শুনে প্রতিক্রয়ায়- বেশীর ভাগই হাসেন। কিন্তু উত্তর দেন না। অনেক দুষ্ট ছেলে নাফিকে ভেঙ্গায়। নাফির উচ্চারিত শব্দগুলো বিকৃত করে উচ্চারণ করে। আমার কানে আসে। তখন চট করে মাথায় রক্ত চড়ে যায়! চিৎকার করে এই সমাজটাকে বলতে ইচ্ছে করে- Don’t make this shit. Get off his back! কিন্তু বলতে পারি না। হ্যাঁ, এমন অনেকবার হয়েছে যে ভেঙ্গানোর সাথে সাথে নির্দিষ্ট ছেলেটাকে ধরে ফেলেছি। বেশ শক্ত করে হাত ধরে বলেছি- “কি বললি রে তুই?” কিন্তু ঐ মুহুর্তে আমার চেহারা দেখে সে এতটাই ভয় পেয়ে যায় যে, তোতলাতে থাকে। আমি নিশ্চিত সে আর কোনদিন কিছু বলার সাহস পাবে না। তখন আর কিছু না বলে, ছেড়ে দেই তাকে।
এটা তো গেল বাইরের মানুষের কথা। নাফির খুব কাছের মানুষরাই তো ওকে বোঝে না। ওর আপন মেজ মামা- যে কিনা আমাদের ১০০ মিটারের মধ্যে বাস করে, সেদিন মাত্র নাফির মাকে প্রশ্ন করলো – “ও কানে আংগুল দিয়ে রাখসে কেন?!” ওর মায়ের উল্টো প্রশ্ন – “তুই মামা হয়ে এতদিনে জানিস না কেন?” সে আসলে সৌজন্য রক্ষার্থে প্রশ্ন করতে যেয়ে বিপাকে পড়ে গিয়েছিল! নাফির সাথে ওর চাচা-মামাদের কেউই বলতে গেলে কথা বলে না। খোঁজও রাখে না। ওর কাজিনরাও তাই। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলে সবাই। ব্যতিক্রম দেখেছি ওর বড় মামা এবং ওর একমাত্র খালাতে বোন রিয়ার ক্ষেত্রে। ওরা দেখা হলেই হাসি মুখে হ্যান্ডসেক করে। কথা বলে নাফির সাথে। খোঁজ-খবরও কম-বেশী রাখে। আমার ভাল লাগে। ওর ছোট মামা দেখা হলে, না-বুঝে হলেও কথা বলে নাফির সাথে। ‍কিন্তু খোঁজ নেয় না কখনো। কিন্তু বাকীরা ভয় পায় এবং দৌড়ে পালায়। নাফির ছোট চাচা ওকে অনেক ভালবাসে। তার ভালবাসা কৃতজ্ঞতার সাথে মনে রাখার মত। কিন্তু নাফিকে, বড় হবার পর দেখেছে মাত্র একবার। দূর থেকে খবর রাখে। সহযোগীতা করে। তার মেজো চাচাও বাসায় এসে দেখে গেছে ২ বার। সেটা নাফিকে বোঝার চাইতে সৌজন্যতা রক্ষাই ছিল বড় বিষয়। আমার হাতে গোনা এই ক’জন মানুষ ছাড়া কেউ নেই ওর সাথে কথা বলার মত। দুঃখজনক হলেও সত্যি- যাদের কথা এতক্ষণ বললাম, তারা কেউই কিন্তু বোঝে না ওকে। অটিজম সম্পর্কেও কোন ধারণা নেই তাদের। এমনকি জানার আগ্রহটাও নেই। আরেকটি অত্যন্ত বাজে রকমের ব্যাপার হলো- ওর একমাত্র খালু ওকে দেখা মাত্রই স্পর্শকাতর জায়গায় হাত চালিয়ে খোঁচা মারতে খুবই পছন্দ করে এবং মহামিশুক মানুষদের মত নাফিকে প্রশ্ন করেন- “কী খবর?” তার কোন ধারণাই নেই অটিজম কী কিংবা এতে করে নাফির ঠিক কেমন অনুভূতি হতে পারে। আমার খুব বিশ্রী রকমের রাগ হয়। শুধু আত্মীয় বলে- ঠোঁট কামড়ে সামলে নেই নিজেকে। (চলবে)

No comments:

Post a Comment