Friday, December 7, 2018

৯ম পর্বঃ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা-(২)

My brain is different but the thoughts and emotions in it is as real, as valid, as beautiful and as important as anyone’s.
তিন।।
অটিষ্টিক মানুষদের একটা বড় ধরনের সমস্যা হলো স্থান পরিবর্তন করা। আমরা তাই সহজে বাসা পরিবর্তন করতে চাই না। কিন্তু বাসা বদল করলে বেশ কয়েকদিন নাফিকে নিয়ে আমাদের কষ্ট করতে হয়। তার ধারণা হয়- আমাদের নিশ্চয়ই বিরাট কোন ভুল হচ্ছে। এটা আমাদের বাসা না। আমাদের বাসা তো ঐখানে। এবং আমাদের সেই ভুল এতটাই বড় ভুল যা কিনা তার পৃথিবীটাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে। ফলে সে স্কুল কিংবা বাইরে থেকে ফিরে আগের বাসায় যাওয়ার জন্যে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করে। অটিষ্টিক মানুষরা চায় একটা স্থির এবং নিরাপদ জগৎ। সহজাতভাবে পাওয়া ‍শক্তিশালী illusion দিয়ে তিলতিল করে গড়ে তোলা পৃথিবীটা ভেঙ্গে যাওয়া- তার কাছে অনেক বেশী কষ্টের। অনেক বেশী অনিরাপদ। নিত্য ব্যবহৃত বস্তুর প্রতিও ওদের এই একই অনুভূতি সক্রিয় থাকে।
সাম্প্রতিক যে সমস্যাটা আমাদের ভীষণ বিব্রত করছে তাহলো- নাফি ইদানিং আনন্দ করার সময়ে- চিৎকার করতে-করতে, স্কিপিং করার মত ক্রমাগত ৪/৫টা লাফ দেয়। এ’সময়ে লাফ দিয়ে সে মেঝে থেকে প্রায় থেকে ৬-৮ ইঞ্চি মত উঁচুতে উঠে যেতে পারে। প্রতিবার ল্যান্ডিংয়ের পর তার ১৪০ পাউন্ড ওজনের শরীরটা মেঝেতে যে শব্দ তৈরী করে সেটা নিচের তলার ভাড়াটিয়ারা সহ্য করতে রাজি না। নাফি বেচারা জানে না তার আনন্দ করার এই ধরণ সমাজের মানুষগুলো মানতে রাজি না। মনে হয় পৃথিবীটা শুধু তাদের জন্যে- যারা autism friendly পৃথিবী কোনভাবেই মানতে কিংবা নাফিকে দিতে রাজি নয়। আমার বাড়িওয়ালা যেমন মানুষই হোক দীর্ঘ প্রায় ৮টি বৎসর সে নানা রকমের যন্ত্রনার পরেও নাফির প্রতি সহানুভূতিশীল। সম্প্রতি তার ছোট বোন এসে উঠেছে ঠিক আমাদের সোজা নিচে- দোতলায়। আমরা তিন তলায়। এখন প্রতিদিন ২/৩ বার এমন শব্দের ঘটনা নাকি তাদের বিল্ডিংয়ে ফাটল ধরিয়ে দিচ্ছে। ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। তাদের বাচ্চা ভয় পাচ্ছে। সবচে’ বড় সমস্যা তিনি বলছেন- নাফির চিল্লানিতে তার ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়!! অথচ তার আরেক ভাই যখন নিচে প্রাইভেট কার দাঁড় করিয়ে প্রচন্ড হাই ভলিউমে বিদঘুটে এবং বোধগম্যহীন ইংলিশ মিউজিক শোনে- তাতে তার কোন অভিযোগ থাকে না। অথচ তখন আশেপাশের সমস্ত বিল্ডিং-ই সেই শব্দে কাঁপতে থাকে। ইনিয়ে বিনিয়ে, তিলকে তাল বানিয়ে বাসা ছাড়তে হবে সেটা আমাদেরকে নানাভাবে বোঝানো হয়ে গেছে। কিন্তু আমি বাসা ছেড়ে যাব কোথায়? তাই বাড়িওয়ালাকে কে বললাম- “এই পাড়ায় নাফির জন্ম। এখানে সে ১৮টা বছর কাটিয়েছে। কেউ কোনদিন ওর নামে কোন অভিযোগ করেনি। আর আপনার বোন নতুন এসেই আপনাকে এবং আমাদেরকে বোঝাতে শুরু করেছেন – নাফির লাফে বিল্ডিং ফেটে যাচ্ছে। উনি যে মিথ্যা কথা বলছেন- এটা আমি বুঝি। উনি একজন মিথ্যুক এবং অমানবিক। বিল্ডিং যদি ফেটেই থাকে সেটা অন্য কোন কারণে হতে পারে। নাফির লাফে বিল্ডিং ফাটতে পারে না।” বাড়িওয়ালা কিছুই বললেন না আমার কথা শুনে। শেষে কোন উপায় না করতে পেরে নতুন কৌশল নিয়ে এলেন তারা। ভাড়া ৫০০/১০০০ -এর জায়গায় এক লাফে ২০০০ বাড়িয়ে দিলেন। আমিও জানিয়ে দিলাম- ‘আইন অনুযায়ী ভাড়া বাড়াতে হবে। যেমন খুশি বাড়ালে হবে না।’ বাড়িভাড়া আইন এর বিস্তারিত হাতের কাছে রেখে দিয়ে জুন মাসের যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছি। প্রয়োজনে আইনের দ্বারস্থ হবো। জানি তাদের হাত অনেক লম্বা। গায়ে অনেক শক্তি। কিন্তু তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। বাড়িওয়ালা না-আমাদের পক্ষে, না-তার বোনের পক্ষে। তার বোন বাড়িওয়ালার বউকে সাথে নিয়ে কলকাঠি নাড়ছে। যাইহোক, উল্টাপাল্টা ভাড়া বাড়িয়ে তারা ঠিক করেনি। এটা তাদের একটা খুব বাজে রকমের ভুল বুদ্ধি।
চার।।
আজ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমি জানি বেঁচে থাকার জন্যে পরিবারের বাকী সবার পরবর্তী সিকোয়েন্সগুলো কী হবে। জয়ী এবং নাফির জন্যে বেঁচে থাকার একটা ক্ষেত্র কোথাও-না-কোথাও ঠিকই তৈরী করবে তাদের মা। তবে প্রথমেই বাসা ছাড়তে হবে। তারপরে কী হবে সেটা আপনাদের নাইবা বললাম। কিন্তু আমার পরে তার মায়ের মৃত্যু হলে নাফির বেঁচে থাকার ক্ষেত্র তখনও ‍তৈরী হবে। তবে সেটা হবে মরতে মরতে বেঁচে থাকার মতই। কারণ ক্ষুধার জ্বালায় কোন হোটেলে খাবার দেখেও তো সে চাইতে জানে না। চাইতে হলে একজন মানুষের হাতটা আলগোছে ধরে। তারপর তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর কাঙ্খিত খাদ্য বা বস্তুর দিকে সেই ধরে থাকা হাতকে পৌঁছে দেয়- মানে আমাকে এটা দাও। তার চোখের দিকে তাকিয়ে কে বুঝবে গভীরে থাকা আবেদনটুকু। কে দেবে তাকে তার পছন্দমত খাবার? কে বুঝবে তার ত্বক কিংবা শব্দজনিত স্পর্শকতরতা? কে বুঝবে তার একটা নির্দিষ্ট-নিরাপদ পৃথিবী ছাড়া সে কোনভাবেই বাঁচবে না।
এটা সত্যি পৃথিবী কারো জন্যে থেমে থাকে না। আমার আগেও কোটি কোটি মানুষ মারা গেছে। আমার পরেও যাবে। তাতে পৃথিবীর কিছু এসে যায় না। এমন কি নাফি কষ্ট পেয়েও মারা গেলেও পৃথিবীর কিছু এসে যাবে না। তখনও পৃথিবী চলতে থাকবে আগের মতই। তার নিয়মে। হ্যাঁ আমিও জানি এটাই নির্মম সত্যি। কিন্তু মানুষ আমি- তাই কোনভাবেই পৃথিবীর বুকে নাফির কষ্ট মানতে পারবো না। অমানবিকতা, অশিক্ষা আর স্বার্থপরতা- এমন সব বৈশিষ্টের মানুষ দিয়ে ভরা এই সমাজ। ঠিক তার ভিতরেই একটা Autism friendly সমাজ তৈরী কতটা কঠিন সেটা আমি ভালই জানি। আমার কেবলই মনে হয়- সব ছাপিয়ে আমার আত্মাও বোধ হয় নাফির পিছনে পিছনে ঘুরবে- শুধু তার স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্যে। মাঝে মাঝে মনে হয় নাফিকে দেখাশোনার জন্যে সৃষ্টিকর্তা বোধ হয় জয়ীকে সৃষ্টি করেছেন। হয়তো সে কারণে জয়ী সে’রকম সক্ষমতাও একদিন অর্জন করবে। সে এখন মাত্র ক্লাস থ্রীতে পড়ে। জীবনের জটিলতার কিছুই এখনও বোঝেনা। তাছাড়া আমার এ’ধারণা ভুলও হতে পারে!
নাফির জন্যে জয়ীর কথা ভাবতেই আমার ভাবনাগুলো আরো গভীরে ছুটে চলতে থাকে। স্তরের পর স্তর ভেদ করে- আরো গভীরে। জাগতিক ভাবনা পেরিয়ে পৌঁছে যায় অতিজাগতিক ভাবনায়। নির্বোধের মত আমি বুঝতে চাই –এই মহাজগতের সেই আর্কিটেক্চার আমাদের জন্যে তার ডিজাইনটা ঠিক কিভাবে দাঁড় করিয়েছেন! কিন্তু বরাবরের মত আমার জন্যে সেখানে বিষম এক অন্ধকার অপেক্ষা করতে থাকে। আর আমি মানুষ বলেই বোধ হয়, চিরন্তন সেই আক্ষেপ সত্ত্বেও ভাবি- হায়! আমি যদি ফেইট নামের সেই আশ্চর্য ডিজাইনটা কোনভাবে আগেভাগে দেখতে পেতাম! আমার আক্ষেপ প্রতিধ্বনি হয়ে বারবার ফিরে আসে আমার কাছে। আমি আর ভাবতে পারি না। নিজেকে বেশ কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো মনে হয়। হঠাৎ করেই তখন চেতনাবিহীন এই সমাজ আর সেখানে পদচারণারত অধিকাংশ অকর্ষিত মানুষের বোধ-বুদ্ধি-আচরণ আমার কাঁধে বিষম ভারী কোন বোঝার মত মনে হতে থাকে! (চলবে)

No comments:

Post a Comment