Friday, December 7, 2018

১০ম পর্বঃ আমার ভিতরে বাহিরে (আত্মকথাঃ ফারহান আরিফ নাফি)

এক।। 
আমার- কারো কাছে কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। যা কিছু বোঝার- আমি আমার জ্ঞানতঃ বুঝে নেই। তাই কারো কাছে
আমার কোন প্রশ্নও নেই। হ্যাঁ, এটাও সত্যি যে, আমার কোন স্বপ্ন নেই। ভবিষ্যতের কোন স্বপ্ন আমি দেখি না। ‍সত্যি বলতে কী
অটিজম আছে- এমন মানুষগুলোর ভাবনায়- ভবিষ্যৎ কালটাই নেই। শুধু ভবিষ্যৎ কাল কেন, আমরা অতীতকাল নিয়েও 
তোমাদের মত মাথা ঘামাই না। তাই, আমি বেঁচে থাকি শুধু বর্তমান কালকে নিয়ে।  তবে প্রকৃতি আমাকে এমন কিছু পারগতা 
দিয়েছে যার সাহায্যে আমি- তোমার চোখ দিয়ে দেখতে পারি। তোমার অনুভূতিকে হুবহু অনুভব করতে পারি। আমার এই শক্তি 
আমাকে শিখতে সাহায্য করে। এমনকি এটা আমাকে সতর্ক হতেও সাহায্য করে। আমি যখন তোমার দিকে তাকাই, তোমার চোখ 
এবং  ঠোঁটের দিকে আমার তীক্ষ্ণ মনোযোগ থাকে। প্রতিটি শব্দে তোমার প্রতিক্রিয়া আমি মনে রাখি। আমার মস্তিকে তোমার 
অনুভূতির একটা নিখুঁত ছবি তৈরী হয়। এবং সেটা এতটাই নিখুঁত যে- তুমি কল্পনা করেও তা পেতে পার না। তোমার মনে 
হতে পারে আমি ঠিক স্বাভাবিক নই। কিন্তু আমি আমার জন্যে ভীষণভাবেই স্বাভাবিক। 
 
দুই।।
স্কুলে আমার শিক্ষকরা আমাকে শিখতে সাহায্য করে। কিন্তু সেটা যতটা না তাদের মতো করে, তার চে’ বেশী তাঁরা করেন 
সে’ভাবে- যে’ভাবে ঠিক আমি শিখতে পারি। এমন মনে করার কোন কারণ নেই যে অটিজম আছে এমন মানুষগুলো সবাই 
আমার মতো! সে’কারণেই সবার শিক্ষা পদ্ধতিও একই রকমের নয়। বরং আমরা প্রত্যেকেই আলাদা। আমার যেমন- স্পর্শ 
এবং শ্রবণকাতরতা আছে আরেকজনের সেটা নাও থাকতে পারে। কেউ হয়তো ঘূর্ণায়মান বস্তুর প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। 
কেউ হয়তো বিচিত্র কোন কারণে প্রথম দেখা, নতুন মানুষটার মাথার গন্ধ শুঁকে নিতে পছন্দ করে। কেউ হয়তো সবকিছুই 
জিহ্বা দিয়ে অনুভব করতে চায়। সেটা লোহা, কাপড় কিংবা মাটি যাই হোক না-কেন। আমি যেমন কোন কাপড় ভেজা কি-না,
সেটা ঠোঁট দিয়ে অনুভব করি। কেউ হয়তো খুবই শান্ত। আবার কেউ হয়তো হঠাৎ রেগে যায়, এমনকি কাউকে আক্রমণও করে 
বসতে পারে। কেই হয়তো লিখতে পারে,পড়তেও পারে। আবার কেউ শুধু হয়তো এ’দুটির একটিই পারে। হতে পারে- কেউ 
কোনটাই পারে না। কেউ হয়তো কথাও বলতে পারে। কেউ হয়তো পারে না। আমি যেমন কথা বলে উঠি কখনো কখনো। 
আমি কথা বলার পর খেয়াল করে দেখি বাসার সবার চোখে-মুখে আনন্দ চিকচিক করে ওঠে। সেটা ঘটে- আমি কথা বলেছি 
বলে। কিন্তু তুমি জানো না- সেটা হয়তো আমার কাছে শুধু মাত্র ‘শব্দ’ই। কখনো কখনো কেউ কোন শব্দ বেশী উচ্চারণ করলে
আমার মস্তিষ্ক সেটা রিপিট করতে পারে। তুমি তাকে কথা মনে করতেই পার। এমন অনেক শব্দই আমার কাছে আছে। কখনো 
কখনো তিন চারটি শব্দও আমি পুনরাবৃত্তি করতে পারি। তবে এমনও হয়েছে বেশ অনেকবার– যেমন রান্নাঘরের সাথে যে রুম, 
সে’ রুমের আলমিরাতে কিছু একটা খুঁজছি। আমার মা আমাকে খুঁজতে সাহায্য করছে। কিন্তু আলমিরার কোথাও সেটা নেই। 
আমার মা হয়তো আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে- জিনিষটি এখানে নেই। কিন্তু- তার কথা তখন, আমার কাছে সঠিক মনে 
হয়না। আমি মরিয়া হয়ে খুঁজতেই থাকি। শেষ পর্যন্ত না-পেলে, তীব্র রাগ এসে আমাকে গ্রাস করে। আমি একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে
“দীপু পাপা” বলে চিৎকার করতে করতে তার কাছে ছুঁটে যাই। অর্থাৎ আমি তার সাহায্য চাই। এটা হয়তো শব্দের সঠিক 
প্রয়োগ। কিন্তু এটা কী কথা? আসলে এটা যতটা না কথা তার চে’ বেশী- শব্দের পরে শব্দ পুনরাবৃত্তি করা। আমাকে যদি 
বলা হয় “নাফি এখন ভাত খাবে। এসো।” শব্দগুলোর প্রয়োগ-ক্ষেত্র মনে রেখে পরবর্তীতে আমার প্রয়োজনে হয়তো মাকে বলতে 
পারি- “নাফি ভাত খাবে।” কিন্তু সেটা যে বলতে পারবো – তেমন নাও হতে পারে। আবার এমনিতেই বারবারই বলতে পারি 
– “নাফি ভাত খাবে।” সেটা কিন্তু শব্দগুলোকে মুখস্ত করার জন্যে নয়, বরং হতে পারে “শব্দগুলো বেশ আকর্ষণীয় কিংবা 
প্রয়োজনীয় বলেই আমার মস্তিষ্ক সেটা রিপিট করে যাচ্ছে! আমার মতো এ’রকম- প্রত্যেকেরই একাধিক বৈচিত্রময় বৈশিষ্ট্য থাকতে 
পারে। আর সে’কারণেই বলা হয় যে- “যদি তুমি অটিজম আছে এমন একজনকেও দেখে থাক, তাহলে তুমি একজনকেই 
দেখেছ।” অর্থাৎ সেটা দিয়ে কখনোই অটিজমকে বোঝা যায় না। আমাদের প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য, এমন কি ভিন্ন মাত্রার 
অটিজম আছে। তবে বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয়ে মিল নিশ্চয়ই আছে। যেমন আমরা প্রত্যেকেই একটা সিকোয়েন্স অনুসরণ 
করে চলতে পছন্দ করি- যেটা আমি আগেও বলেছি। আমাদের প্রত্যেকেরই এক বা একাধিক ইন্দ্রিয়গত স্পর্শকাতরতা থাকতে পারে।
পৃথিবীকে আমরা ভিন্ন একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি- যেটাকে তুমি কোনভাবেই ভুল বলতে পার না। হতে পারে- স্পর্শানুভূতিকে 
প্রগাঢ়তরভাবে অনুভব করা, শব্দকে উচ্চতরভাবে শুনতে পাওয়া, ঘ্রাণকে গভীরভাবে পাওয়া কিংবা কোন কিছুকে স্পষ্টতরভাবে
দেখা- এই বৈশিষ্ট্যেগুলোতে বেশ মিল আছে। এ’ছাড়া রকিং- মানে দোল খাওয়া কিংবা স্পিনিং- অর্থাৎ এক জায়গায় ঘুরতে
থাকা এটাও অনেকটা কমন বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই পড়ে। যেমন আমি বিছানায় কিংবা চেয়ারে বসে রকিং পছন্দ করি। আসলে 
তোমাদের উচিত আমরা কী পারছি-না সেটা নয়, বরং কী পারছি, কিভাবে পারছি সেটার দিকে লক্ষ্য করা এবং সেটা করতে
আমাদেরকে সাহায্য করা। 
 
তিন।। 
অটিজম আমাকে কোথাও কোথাও হয়তো কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়। তেমনি কোন 
কোন ক্ষেত্রে আবার বেরও করে আনে- অনেক সমস্যার সহজ-সমাধান করে দেয়। এবং সেটা ঘটে অনেকটাই শক্তিশালী চুম্বকের
আর্কষণ অথবা বিকর্ষণ শক্তির মতো করে। এটা কখনো হয়তো আমাকে তীব্র আঘাত করে আবার কোথাও আমাকে স্বাভাবিকের 
চাইতেও বেশী শক্তি জোগায়। আর- তুমি যখন কোন বস্তুর (object) দিকে তাকাও তখন তুমি প্রথমে সেটার পুরোটা দেখ 
এবং এরপরই তুমি ধাপে ধাপে তার বিস্তারিত (details) দেখতে পাও। কিন্তু যার অটিজম আছে সে প্রথমেই বিস্তারিতের 
মধ্যে লাফ দিয়ে পড়ে। তারপর ধাপে ধাপে সম্পূর্নটা দেখতে পায়। 

চার।।
সমাজ বা পৃথিবী আমাকে কিভাবে দেখে বা আমাকে কেমন দেখায়- আমি সেটা গ্রাহ্য করি না। ভয়ডরহীনভাবে আমি সেটাই 
করি যা আমি করতে চাই। তোমার মনে হতে পারে অটিজম আছে এমন শিশুর- তার বিশেষ চাওয়াগুলো নিয়ে বেড়ে উঠা 
সত্যি খুব বাজে ব্যাপার। কিন্তু আমি বলবো সবচে’ বাজে ব্যাপার হলো আমার বিশেষ চাওয়াগুলোর প্রতি তোমাদের খেয়াল 
কিংবা গ্রাহ্য না-করা। আসলে বাইরে থেকে আমাকে দেখে তোমরা যেমন বুঝবে না, তেমন- আমার ভিতর থেকে বাইরে 
তাকিয়েও তোমার মনে হতে পারে –এর কোন ব্যাখ্যা নেই। এটা আসলে- অনেকটাই কম্পিউটারের ভিন্ন অপারেটিং সিস্টেমের
মত। আর কোন কারণে প্রকৃতি সেটা আমার ভিতরে আপলোড করে দিয়েছে। আমি ছাড়া আর কেউ সেই অপারেটিং সিস্টেম
 জানে না। আর সেটাই আমার জীবনের অংশ।  (চলবে)

“I know of nobody who is purely autistic, or purely neuro-typical. Even God has 
some autistic moments, which is why the planets spin.” 
  
-Jerry Newport, 
Author of “Your Life is Not a Label” 
 
জেরী নিউপোর্ট, (জন্ম আগষ্ট ১৯, ১৯৪৮) এর ৪৭ বৎসর বয়সে তার এসপারজার এর উপসর্গ/উচ্চ ক্রিয়াশীল অটিজম ধরা
পড়ে। এবং এই সময়েই তিনি এই বইটি লিখেন। বইটি মূলতঃ অক্ষম মানুষদেরকে গভীরভাবে সম্পৃক্ত করে লেখা। নিজের সাফল্য 
এবং ব্যর্থতা নিয়ে এই বইয়ে তিনি অনেক খোলামেলা কথাবার্তা বলেছেন। জেরী যে কোন বক্তৃতা বা উপস্থাপনার সময়েও অকপটে
 উপদেশ যেমন দিতেন, তেমনি রসিকতাও করতেন প্রচুর। তিনি মিসিগান ইউনিভার্সিটি থেকে অংক শাস্ত্রে স্নাতক সম্পন্ন করেন। 
অংকে তাকে একজন পন্ডিত বলা হয় এবং মুখে মুখে তিনি অনেক জটিল অংক করতে পারতেন। জেরী ২০১০ সালের Mental 
Calculation World Cup in Magdeburg, Germany -তে তিনি অংশগ্রহন করেন। ১০টি ইভেন্টের মধ্যে ৪টিতে 
জয় লাভ করেন। এখানে তিনি ১টিতে ২য়, একটিতে ৩য় এবং World Cup Trophy for "Most Versatile 
Calculator." পদক জয় লাভ করেন। মজার ব্যাপার হলো তার ৪৬তম জন্মদিনে জেরী বিখ্যাত টিভি সিরিজ 
‘ষ্টার ট্রেক’ এর অভিনেত্রী মেরী লুইসকে বিয়ে করেন। জেরী নিউপোর্টের সবচে’ উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- তিনি হলিউডের 
একজন বিখ্যাত screenwriter হিসাবে সাফল্য লাভ করেন। তার লেখা- পল (Pal) অনুসারে ১৯৮৮ সালে নির্মিত হয় 
অটিজমের উপরে এ’যাবৎ কালের সবচে’ বিখ্যাত ছবি “Rain Man”। বলা বাহুল্য, এটি একটি অস্কার জয়ী ছবি। এতে 
ডাস্টিন হফম্যানের মত বিখ্যাত অভিনেতা অটিষ্টিক মানুষের চরিত্রে অভিনয় করেন। টম ক্রুজ এ’ছবিতে তার ভাইয়ের ভূমিকায় 
অভিনয় করেন। অনেক বছর আগে, ছবিটি আমি কয়েকবার দেখেছি। ভাল লেগেছে। ছবিটির লিন্ক নিচে দিয়ে দিয়েছি। 
এ’ছাড়া জেরী নিউপোর্টের বিখ্যাত বই “Your Life is Not a Label” –এর ই-বুকের লিন্কও দিয়েছি। যে কেউ 
চাইলে বইটি পড়ে নিতে পারেন। স্বাভাবিকভাবেই, বইটি ইংরেজীতে লেখা। 


৯ম পর্বঃ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা-(২)

My brain is different but the thoughts and emotions in it is as real, as valid, as beautiful and as important as anyone’s.
তিন।।
অটিষ্টিক মানুষদের একটা বড় ধরনের সমস্যা হলো স্থান পরিবর্তন করা। আমরা তাই সহজে বাসা পরিবর্তন করতে চাই না। কিন্তু বাসা বদল করলে বেশ কয়েকদিন নাফিকে নিয়ে আমাদের কষ্ট করতে হয়। তার ধারণা হয়- আমাদের নিশ্চয়ই বিরাট কোন ভুল হচ্ছে। এটা আমাদের বাসা না। আমাদের বাসা তো ঐখানে। এবং আমাদের সেই ভুল এতটাই বড় ভুল যা কিনা তার পৃথিবীটাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে। ফলে সে স্কুল কিংবা বাইরে থেকে ফিরে আগের বাসায় যাওয়ার জন্যে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করে। অটিষ্টিক মানুষরা চায় একটা স্থির এবং নিরাপদ জগৎ। সহজাতভাবে পাওয়া ‍শক্তিশালী illusion দিয়ে তিলতিল করে গড়ে তোলা পৃথিবীটা ভেঙ্গে যাওয়া- তার কাছে অনেক বেশী কষ্টের। অনেক বেশী অনিরাপদ। নিত্য ব্যবহৃত বস্তুর প্রতিও ওদের এই একই অনুভূতি সক্রিয় থাকে।
সাম্প্রতিক যে সমস্যাটা আমাদের ভীষণ বিব্রত করছে তাহলো- নাফি ইদানিং আনন্দ করার সময়ে- চিৎকার করতে-করতে, স্কিপিং করার মত ক্রমাগত ৪/৫টা লাফ দেয়। এ’সময়ে লাফ দিয়ে সে মেঝে থেকে প্রায় থেকে ৬-৮ ইঞ্চি মত উঁচুতে উঠে যেতে পারে। প্রতিবার ল্যান্ডিংয়ের পর তার ১৪০ পাউন্ড ওজনের শরীরটা মেঝেতে যে শব্দ তৈরী করে সেটা নিচের তলার ভাড়াটিয়ারা সহ্য করতে রাজি না। নাফি বেচারা জানে না তার আনন্দ করার এই ধরণ সমাজের মানুষগুলো মানতে রাজি না। মনে হয় পৃথিবীটা শুধু তাদের জন্যে- যারা autism friendly পৃথিবী কোনভাবেই মানতে কিংবা নাফিকে দিতে রাজি নয়। আমার বাড়িওয়ালা যেমন মানুষই হোক দীর্ঘ প্রায় ৮টি বৎসর সে নানা রকমের যন্ত্রনার পরেও নাফির প্রতি সহানুভূতিশীল। সম্প্রতি তার ছোট বোন এসে উঠেছে ঠিক আমাদের সোজা নিচে- দোতলায়। আমরা তিন তলায়। এখন প্রতিদিন ২/৩ বার এমন শব্দের ঘটনা নাকি তাদের বিল্ডিংয়ে ফাটল ধরিয়ে দিচ্ছে। ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। তাদের বাচ্চা ভয় পাচ্ছে। সবচে’ বড় সমস্যা তিনি বলছেন- নাফির চিল্লানিতে তার ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়!! অথচ তার আরেক ভাই যখন নিচে প্রাইভেট কার দাঁড় করিয়ে প্রচন্ড হাই ভলিউমে বিদঘুটে এবং বোধগম্যহীন ইংলিশ মিউজিক শোনে- তাতে তার কোন অভিযোগ থাকে না। অথচ তখন আশেপাশের সমস্ত বিল্ডিং-ই সেই শব্দে কাঁপতে থাকে। ইনিয়ে বিনিয়ে, তিলকে তাল বানিয়ে বাসা ছাড়তে হবে সেটা আমাদেরকে নানাভাবে বোঝানো হয়ে গেছে। কিন্তু আমি বাসা ছেড়ে যাব কোথায়? তাই বাড়িওয়ালাকে কে বললাম- “এই পাড়ায় নাফির জন্ম। এখানে সে ১৮টা বছর কাটিয়েছে। কেউ কোনদিন ওর নামে কোন অভিযোগ করেনি। আর আপনার বোন নতুন এসেই আপনাকে এবং আমাদেরকে বোঝাতে শুরু করেছেন – নাফির লাফে বিল্ডিং ফেটে যাচ্ছে। উনি যে মিথ্যা কথা বলছেন- এটা আমি বুঝি। উনি একজন মিথ্যুক এবং অমানবিক। বিল্ডিং যদি ফেটেই থাকে সেটা অন্য কোন কারণে হতে পারে। নাফির লাফে বিল্ডিং ফাটতে পারে না।” বাড়িওয়ালা কিছুই বললেন না আমার কথা শুনে। শেষে কোন উপায় না করতে পেরে নতুন কৌশল নিয়ে এলেন তারা। ভাড়া ৫০০/১০০০ -এর জায়গায় এক লাফে ২০০০ বাড়িয়ে দিলেন। আমিও জানিয়ে দিলাম- ‘আইন অনুযায়ী ভাড়া বাড়াতে হবে। যেমন খুশি বাড়ালে হবে না।’ বাড়িভাড়া আইন এর বিস্তারিত হাতের কাছে রেখে দিয়ে জুন মাসের যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছি। প্রয়োজনে আইনের দ্বারস্থ হবো। জানি তাদের হাত অনেক লম্বা। গায়ে অনেক শক্তি। কিন্তু তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। বাড়িওয়ালা না-আমাদের পক্ষে, না-তার বোনের পক্ষে। তার বোন বাড়িওয়ালার বউকে সাথে নিয়ে কলকাঠি নাড়ছে। যাইহোক, উল্টাপাল্টা ভাড়া বাড়িয়ে তারা ঠিক করেনি। এটা তাদের একটা খুব বাজে রকমের ভুল বুদ্ধি।
চার।।
আজ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমি জানি বেঁচে থাকার জন্যে পরিবারের বাকী সবার পরবর্তী সিকোয়েন্সগুলো কী হবে। জয়ী এবং নাফির জন্যে বেঁচে থাকার একটা ক্ষেত্র কোথাও-না-কোথাও ঠিকই তৈরী করবে তাদের মা। তবে প্রথমেই বাসা ছাড়তে হবে। তারপরে কী হবে সেটা আপনাদের নাইবা বললাম। কিন্তু আমার পরে তার মায়ের মৃত্যু হলে নাফির বেঁচে থাকার ক্ষেত্র তখনও ‍তৈরী হবে। তবে সেটা হবে মরতে মরতে বেঁচে থাকার মতই। কারণ ক্ষুধার জ্বালায় কোন হোটেলে খাবার দেখেও তো সে চাইতে জানে না। চাইতে হলে একজন মানুষের হাতটা আলগোছে ধরে। তারপর তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর কাঙ্খিত খাদ্য বা বস্তুর দিকে সেই ধরে থাকা হাতকে পৌঁছে দেয়- মানে আমাকে এটা দাও। তার চোখের দিকে তাকিয়ে কে বুঝবে গভীরে থাকা আবেদনটুকু। কে দেবে তাকে তার পছন্দমত খাবার? কে বুঝবে তার ত্বক কিংবা শব্দজনিত স্পর্শকতরতা? কে বুঝবে তার একটা নির্দিষ্ট-নিরাপদ পৃথিবী ছাড়া সে কোনভাবেই বাঁচবে না।
এটা সত্যি পৃথিবী কারো জন্যে থেমে থাকে না। আমার আগেও কোটি কোটি মানুষ মারা গেছে। আমার পরেও যাবে। তাতে পৃথিবীর কিছু এসে যায় না। এমন কি নাফি কষ্ট পেয়েও মারা গেলেও পৃথিবীর কিছু এসে যাবে না। তখনও পৃথিবী চলতে থাকবে আগের মতই। তার নিয়মে। হ্যাঁ আমিও জানি এটাই নির্মম সত্যি। কিন্তু মানুষ আমি- তাই কোনভাবেই পৃথিবীর বুকে নাফির কষ্ট মানতে পারবো না। অমানবিকতা, অশিক্ষা আর স্বার্থপরতা- এমন সব বৈশিষ্টের মানুষ দিয়ে ভরা এই সমাজ। ঠিক তার ভিতরেই একটা Autism friendly সমাজ তৈরী কতটা কঠিন সেটা আমি ভালই জানি। আমার কেবলই মনে হয়- সব ছাপিয়ে আমার আত্মাও বোধ হয় নাফির পিছনে পিছনে ঘুরবে- শুধু তার স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্যে। মাঝে মাঝে মনে হয় নাফিকে দেখাশোনার জন্যে সৃষ্টিকর্তা বোধ হয় জয়ীকে সৃষ্টি করেছেন। হয়তো সে কারণে জয়ী সে’রকম সক্ষমতাও একদিন অর্জন করবে। সে এখন মাত্র ক্লাস থ্রীতে পড়ে। জীবনের জটিলতার কিছুই এখনও বোঝেনা। তাছাড়া আমার এ’ধারণা ভুলও হতে পারে!
নাফির জন্যে জয়ীর কথা ভাবতেই আমার ভাবনাগুলো আরো গভীরে ছুটে চলতে থাকে। স্তরের পর স্তর ভেদ করে- আরো গভীরে। জাগতিক ভাবনা পেরিয়ে পৌঁছে যায় অতিজাগতিক ভাবনায়। নির্বোধের মত আমি বুঝতে চাই –এই মহাজগতের সেই আর্কিটেক্চার আমাদের জন্যে তার ডিজাইনটা ঠিক কিভাবে দাঁড় করিয়েছেন! কিন্তু বরাবরের মত আমার জন্যে সেখানে বিষম এক অন্ধকার অপেক্ষা করতে থাকে। আর আমি মানুষ বলেই বোধ হয়, চিরন্তন সেই আক্ষেপ সত্ত্বেও ভাবি- হায়! আমি যদি ফেইট নামের সেই আশ্চর্য ডিজাইনটা কোনভাবে আগেভাগে দেখতে পেতাম! আমার আক্ষেপ প্রতিধ্বনি হয়ে বারবার ফিরে আসে আমার কাছে। আমি আর ভাবতে পারি না। নিজেকে বেশ কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো মনে হয়। হঠাৎ করেই তখন চেতনাবিহীন এই সমাজ আর সেখানে পদচারণারত অধিকাংশ অকর্ষিত মানুষের বোধ-বুদ্ধি-আচরণ আমার কাঁধে বিষম ভারী কোন বোঝার মত মনে হতে থাকে! (চলবে)

৮ম পর্বঃ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা-(১)

“You can’t punish a child who is acting out because of sensory overload.”
-Dr. Temple Grandin (The writer of “The Autistic Brain”)
এক।।
একটা অটিজম-বান্ধব সমাজ নাফির জন্যে নিশ্চয়ই বিশাল কিছু। বর্তমান সমাজে অটিজম সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানে। আমি অনেক ডাক্তারকে পেয়েছি যারা অটিজম শব্দটাই শোনেননি। তার মধ্যে শেষের জনের কথা বলি। ৮/৯ মাস আগের কথা। মশার কামড়ে নাফি তার দুই পায়ের পাতা চুলকিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলতো। সে নিজে মশারী ব্যবহার করে না এবং কাউকে করতেও দেয় না। আমরা মলম লাগিয়ে ঘা শুকানোর অপেক্ষায় থাকতাম। কিন্তু ঘা শুকানোর সময়ে যখন ত্বকে টান পড়ে, তখন সে তীব্র চুলকানি বোধ করতো, ফলে আবারো সেখানে চুলকিয়ে সেই ঘাকে কাঁচা বানিয়ে ফেলতো। কোনভাবেই শুকানো পর্যন্ত পৌঁছুতে পারছিলাম না। এখানে বোঝার বিষয়টা হলো- আপনি কোথাও চুলাকোনোর জন্যে যে অনুভূতি সাধারণভাবে অনুভব করেন, নাফি সেই অনুভূতি অনেক গুণ বেশী অনুভব করে- শুধুমাত্র তার জন্মগতভাবে পাওয়া স্পর্শকাতর ত্বকের কারণে। একটা সময়ে এমন হলো যে আঁড়ালেই সে দুই পা রক্তাক্ত করে চুপচাপ শুয়ে থাকতো। রক্তের ধারা দুই পা বেয়ে নেমে চাদর, কোল বালিশ সব রক্তাক্ত করে দিতো। কয়েকমাস পেরিয়ে গেলেও এই সমস্যার সমাধান যখন করতে পারছিলাম না তখন ধানমন্ডির কমফোর্ট হসপিটালে নেয়া হলো। সে’দিন দু’জন ডাক্তারকে দেখাতে হলো। প্রথমজন নিউরোলজিস্ট ডাক্তার। অন্যান্য রোগীদের পাশাপাশি অটিস্টিকদেরও চিকিৎসা করেন। কিন্তু কোন কারণবশতঃ তিনি অটিস্টিকদের ক্ষেত্রে কোন ফি নেন না। অত্যন্ত অমায়িক এই ডাক্তার যেমন প্রচুর প্রশ্ন করেন তেমনি সময় নিয়ে রুগীকেও দেখেন। আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ। দ্বিতীয়জন স্কীন বিশেষজ্ঞ। এই দ্বিতীয়জন অটিজম শব্দটাই শোনেননি! অটিজম কী সেটি বোঝার জন্যে কয়েকটি প্রশ্ন করতে করতে অবাক হয়ে নাফির দিকে তাকালেন কয়েকবার। এরপর দূর থেকে টর্চ জ্বেলে নাফির পা দু’টো দেখলেন একনজর। এরপর প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে আবারও অবাক চোখে নাফিকে দেখে নিলেন কয়েকবার। ব্যস্! তিনি তার ফি-টাও নিলেন মোটা অংকের। অবশ্য তার ঔষধে কাজ হয়েছিল। এটাতো গেল ডাক্তারদের কথা। সাধারণ মানুষদের মধ্যেও খুব কম মানুষই অটিজম সম্পর্কে ধারণা রাখেন।
দুই।।
আমাদের পাড়ায় নাফিকে দেখলে ছোট ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে, যুবক-যুবতী, শক্ত সামর্থ পুরুষ/মহিলা- অনেকেই ভয় পায়। বোধ হয় পাগল-টাগল মনে করে। ভয়ে চিৎকার করে দৌড়ে পালায় এমনও আছে অনেকে। অথচ সে দেখতে একবারেই স্বাভাবিক মানুষের মত। হাঁটা, চলাফেরাও তাই। কাউকে আঘাত করে না। এমনিতেই যারা অটিষ্টিক, তারা বাইরে থেকে দেখতে সাধারন মানুষদের মত হয়। কেউ বলে না দিলে আপনি বুঝবেন না তার অটিজম আছে। নাফি যখন স্কুল থেকে বাসায় ফেরে তখন আমাদের গা-ঘেষাঘেষি করে দাঁড়ানো ৭/৮ টি ফ্লাটের অনেক গৃহিনীদের দেখি দল বেঁধে নিচে আড্ডায় ব্যস্ত থাকেন। অনেকেই যাঁরা আমাদের প্রবেশ পথের কাছাকাছি থাকেন- নাফিকে দেখলেই দৌড়ে পালান। ওদের দেখাদেখি ছোটরাও একই কাজ করে। বীনার খারাপ লাগে। কিন্তু সে বিরক্তি প্রকাশ করে না। আমি রেগে যাই। তাদের উপাধি দেই ছাগল। অনেক সময়ে অনেককে প্রশ্ন করি – “আপনি দৌড় দিলেন কেন?”। আজ পর্যন্ত কাউকে পেলাম না যিনি আমার এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে চেষ্টা করেছেন। প্রশ্ন শুনে প্রতিক্রয়ায়- বেশীর ভাগই হাসেন। কিন্তু উত্তর দেন না। অনেক দুষ্ট ছেলে নাফিকে ভেঙ্গায়। নাফির উচ্চারিত শব্দগুলো বিকৃত করে উচ্চারণ করে। আমার কানে আসে। তখন চট করে মাথায় রক্ত চড়ে যায়! চিৎকার করে এই সমাজটাকে বলতে ইচ্ছে করে- Don’t make this shit. Get off his back! কিন্তু বলতে পারি না। হ্যাঁ, এমন অনেকবার হয়েছে যে ভেঙ্গানোর সাথে সাথে নির্দিষ্ট ছেলেটাকে ধরে ফেলেছি। বেশ শক্ত করে হাত ধরে বলেছি- “কি বললি রে তুই?” কিন্তু ঐ মুহুর্তে আমার চেহারা দেখে সে এতটাই ভয় পেয়ে যায় যে, তোতলাতে থাকে। আমি নিশ্চিত সে আর কোনদিন কিছু বলার সাহস পাবে না। তখন আর কিছু না বলে, ছেড়ে দেই তাকে।
এটা তো গেল বাইরের মানুষের কথা। নাফির খুব কাছের মানুষরাই তো ওকে বোঝে না। ওর আপন মেজ মামা- যে কিনা আমাদের ১০০ মিটারের মধ্যে বাস করে, সেদিন মাত্র নাফির মাকে প্রশ্ন করলো – “ও কানে আংগুল দিয়ে রাখসে কেন?!” ওর মায়ের উল্টো প্রশ্ন – “তুই মামা হয়ে এতদিনে জানিস না কেন?” সে আসলে সৌজন্য রক্ষার্থে প্রশ্ন করতে যেয়ে বিপাকে পড়ে গিয়েছিল! নাফির সাথে ওর চাচা-মামাদের কেউই বলতে গেলে কথা বলে না। খোঁজও রাখে না। ওর কাজিনরাও তাই। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলে সবাই। ব্যতিক্রম দেখেছি ওর বড় মামা এবং ওর একমাত্র খালাতে বোন রিয়ার ক্ষেত্রে। ওরা দেখা হলেই হাসি মুখে হ্যান্ডসেক করে। কথা বলে নাফির সাথে। খোঁজ-খবরও কম-বেশী রাখে। আমার ভাল লাগে। ওর ছোট মামা দেখা হলে, না-বুঝে হলেও কথা বলে নাফির সাথে। ‍কিন্তু খোঁজ নেয় না কখনো। কিন্তু বাকীরা ভয় পায় এবং দৌড়ে পালায়। নাফির ছোট চাচা ওকে অনেক ভালবাসে। তার ভালবাসা কৃতজ্ঞতার সাথে মনে রাখার মত। কিন্তু নাফিকে, বড় হবার পর দেখেছে মাত্র একবার। দূর থেকে খবর রাখে। সহযোগীতা করে। তার মেজো চাচাও বাসায় এসে দেখে গেছে ২ বার। সেটা নাফিকে বোঝার চাইতে সৌজন্যতা রক্ষাই ছিল বড় বিষয়। আমার হাতে গোনা এই ক’জন মানুষ ছাড়া কেউ নেই ওর সাথে কথা বলার মত। দুঃখজনক হলেও সত্যি- যাদের কথা এতক্ষণ বললাম, তারা কেউই কিন্তু বোঝে না ওকে। অটিজম সম্পর্কেও কোন ধারণা নেই তাদের। এমনকি জানার আগ্রহটাও নেই। আরেকটি অত্যন্ত বাজে রকমের ব্যাপার হলো- ওর একমাত্র খালু ওকে দেখা মাত্রই স্পর্শকাতর জায়গায় হাত চালিয়ে খোঁচা মারতে খুবই পছন্দ করে এবং মহামিশুক মানুষদের মত নাফিকে প্রশ্ন করেন- “কী খবর?” তার কোন ধারণাই নেই অটিজম কী কিংবা এতে করে নাফির ঠিক কেমন অনুভূতি হতে পারে। আমার খুব বিশ্রী রকমের রাগ হয়। শুধু আত্মীয় বলে- ঠোঁট কামড়ে সামলে নেই নিজেকে। (চলবে)

Thursday, December 21, 2017

৭ম পর্বঃ আমার চোখে নাফি- (২)

পানি আর বিদ্যূতবিহীন জ্যৈষ্ঠ্যের খর-তাপে পোড়া দুপুরটাকে আজ অন্যরকম লাগে। অন্য দশটা দিনের সাথে কোন মিল নেই। ঢাকার তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বাতাস বইছে না। গাছগুলো পাতা কাঁধে নিয়ে বিমর্ষ দাঁড়িয়ে- তাপদগ্ধ, প্রাণ করতলে। আমাদের মতই। এলাকায় বিদ্যূৎ নেই সকাল থেকে। বিদ্যূৎবিহীন সকালগুলোকে ঠিক লবনবিহীন পান্তার মত পানসে লাগে! শুধু চুপচাপ গিলে যাও! তার উপরে গতকাল থেকে পানি নেই এই ফ্ল্যাটে। প্রথম কারণ- ট্যাংকি পরিস্কার করতে হবে। সেটা প্রায় সারাদিনের কাজ। অথচ বাড়িওয়ালা কাউকে সেই মেসেজটা পর্যন্ত দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। আমাদের যেটা হলো- হঠাৎ ভয়ন্কর ময়লা পানি আসতে শুরু করার পর আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। ড্রামে যে পানিটুকু ছিল তাও নষ্ট হয়ে গেল। দ্বিতীয় কারণ- সারাদিন ধরে ট্যাংকি পরিস্কার করে, রাতে পানি দিতে গিয়ে- পানির মটরটাই জ্বলে গেল। কখন ঠিক হবে- কেউ জানে না। ঘরের ভিতরে আঁটকে থাকা গরম-গুমোট বাতাসটার ওজন বেড়ে গেছে মনে হয়। হাতপাখা চালিয়ে বাতাস করে যাচ্ছি নাফিকে। সেই সংগে নিয়ম মাফিক নাফির জন্যে গানও গাইছি। কিন্তু ভাল বোধ করছি না বলে, অনেকটা আবেগহীনভাবে দু’টো গানই বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গাইছি– “কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া” এবং “চোখের আলোয় দেখেছিলাম চোখের বাহিরে।” মাঝে মাঝেই গানের লাইনও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। লাইন ভুল হলে সাথে সাথে নাফির দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি- তার কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি-না! আমাদের চার চোখের মিলন হলে, আমি ওকে হাসি উপহার দিচ্ছি। কিন্তু আমার হাসির প্রত্যুত্তরে সে প্রতিক্রিয়াহীন। গম্ভীর।
ওর গায়ের জামাটা ঘামে ভিজে সপসপে হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা খুলতে দিতে রাজী নয় সে কোনভাবেই। পাখার বাতাসটা ওর ঠান্ডা লাগার কথা। সে চুপচাপ। শুয়ে শুয়েই হাতের কার্ডগুলো নিয়ে আপন মনে খেলছে। সমস্ত মনোযোগ দু’হাতের আংগুলে ধরা কার্ডের দিকে। তার মাথা এবং পিঠের নিচে বালিশ-বিছানা ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই সে উঠে বসে খেলতে খেলতে অনবরত শরীর দোলাচ্ছে। অটিস্টিকদের বেলায় ক্রমাগত হাত বা পা নাড়ানো, একা একা নিজে নিজে নড়তে থাকা বা শরীর দোলানো, একা একা এক জায়গায় ঘুরতে থাকা, নিজের শরীরকে নিজে চেপে ধরা বা কোন নির্দিষ্ট শব্দ বা কয়েকটি শব্দ ক্রমাগত বলতে থাকা –এ’সব খুব common দৃশ্য। এ আচরণগুলোকে stimming বলা হয়। Stimming বলতে সহজ ভাষায় Self-stimulatory behavior বা আচরণকে বোঝায়, যাকে অনেক সময় stereo-type আচরণও বলা হয়।
আমি ঘামছি খালি গায়ে। কালো শরীরটা ভেজা, চকচকে। কল-কল করে ঘাম নেমে যাচ্ছে কোমরে। সেখানে জিনসের ট্রাউজারটা ঘাম শুষে নিতে-নিতে গাঢ় নীল হয়ে গেছে। বারান্দায় এসে উঁকি দিয়ে দেখছি জয়ীকে দেখা যায় কি-না। মায়ের সাথে সে গোসল করতে নানু বাড়িতে গেছে। নাহ্, দেখা নেই ওদের। ফোন দিতেই সেটা রিসিভ করলো জয়ী। জিজ্ঞেস করলাম- আর কতক্ষণ লাগতে পারে? মিষ্টি করে বললো “ আম্মু বাথরুমে। আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবো। কেন তোমার ক্ষুধা লেগেছে, দীপু?” কী বলবো- খুঁজে না-পেয়ে বললাম- “না তো, মা। ক্ষুধা লাগেনি। সব ঠিক আছে। তোমরা এসো। ঠিক আছে- আমি রাখছি।” জয়ী এবং তার মা এলো আধাঘন্টা বাদে। প্রায় সাথে সাথে বিদ্যূৎ এবং পানিও এলো! আমিও সিকোয়েন্স অনুযায়ী আমার ছেঁড়া টি-শার্টটা পরে নিলাম। গুটিয়ে রাখা জানালার ভারী পর্দা ফেলে দিয়ে ঘর অন্ধকার করে দিলাম। কিন্তু অনেক যন্ত্রনার পর পাওয়া সব আনন্দ ছিঁড়ে-ফুঁড়ে জয়ী ঘোষনা দিল- সে আর তার ভাইয়ার পছন্দে জামা-কাপড় পরবে না। কোনভাবেই না। ফলে সে বেছে নিল- একটা নীল টি-শার্ট। সাথে কালো রংয়ের ট্রাউজার। ওকে আমি সমর্থন করতে পারছি না কারণ, নাফি রিয়েক্ট করতে পারে- এটা ভেবে। আবার মনে হলো- ঠিক আছে। পরুক না কিছুক্ষণ। নাফির থেকে একটু চোখের আড়ালে থাকলেই তো হলো! ছোট্ট মানুষটা আর কতক্ষণ সব মেনে নিয়ে চলবে? নাফি চাইলে আবার না হয় পরবে- কিংবা তখন দেখা যাবে! আমি সায় দিলাম- “ঠিক আছে মা পরো। কিন্তু তুমি ঐ রুমে যেও না। এদিকে থাক।” তার তাৎক্ষণিক উত্তর- “কেন যাব না। আমি কি বাইরের মানুষ? তুমি ভাইয়াকে বলে দাও, আমি আমার পছন্দমত জামা কাপড় পরবো।” আমার কন্ঠে ভয় এবং বিরক্তি- “আহ্-হা, জয়ী! তুমি বোঝ না। আমি তোমাকে যেটা বললাম- তুমি সে’ভাবে চলবে। একদম বুঝতে পারছো না তুমি- তোমার ভাইয়া দেখলে কী হতে পারে!”
জয়ী তার পছন্দের জামা-কাপড় পরার পর থেকেই আমার সমস্ত মনোযোগ দু’জনের উপরেই পালা করে ঘুরছে। কিন্তু শেষ রক্ষাটা হলো না। নাফির চোখে জয়ী ধরা পড়ার সাথে সাথে সে উঠে দাঁড়ালো। ওর পরবর্তী প্রতিটা ধাপ আমার মুখস্ত। আমি জানি- ও এখন কী কী করবে। আমি দ্রুত চলে গেলাম ওর কাছে। ততক্ষণে নাফি ছুটে গিয়ে জয়ীর খুলে ফেলা জামা কাপড় গুলো হাতে নিয়ে, আপাত-দৃষ্টিতে শান্তভাবেই শুধু জয়ীর দিকে হাত বাড়িয়ে ধরে আছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি- নাফি আসলে breaking point-এর কাছাকাছি চলে এসেছে। দূর্ভাগ্য আমার, সেটা আমি ছাড়া আর কেউ ধরতে পারে না। কারণ- বাইরে থেকে ওকে একদম শান্ত দেখায় এ’সময়ে। কিন্তু ভিতরের মানুষটা এখন বিস্ফোরণ উন্মুখ একটা টাইম বোমার মতই! শুধু জয়ী প্রকাশ্যে আপত্তি জানালেই বিস্ফোরণটা ঘটে যাবে। আমি দ্রুত ওর হাত থেকে জয়ীর কাপড়গুলো নিয়ে কৃত্রিম আদেশের মত করে বললাম- “জয়ী যাও, এ’গুলো পরে এসো।” নাফি আমার পিছনেই দাঁড়ানো। সে মাইন্ড রিডিং ভালই জানে। তাই সে স্পষ্ট পড়তে পারছে জয়ীকে। আমার ভিতরে চেপে রাখা টেনশন আর অবচেতনে যুদ্ধের প্রস্তুতি! ঠিক জয়ী যে মূহুর্তে বিরক্তি প্রকাশ করে নাফির দেয়া পোশাক পরতে আপত্তি জানালো- আমার পিছনে মনে হলো বোমা ফাটলো। আতকিংত হওয়ার মতই ভয়ন্কর এক চিৎকার দিয়ে বিস্ফোরণটা ঘটিয়ে দিল নাফি। শুরু হলো সে’দিনের যুদ্ধ। প্রথম আক্রমণটা আমাকেই করলো। এরপর আমাকে ছেড়ে প্রচন্ড জোরে-জোরে থাপ্পড় মারতে শুরু করলো- নিজের কান, মাথা আর গাল জুড়ে। প্রায় ঘন্টা তিনেকের যুদ্ধের পরে আবিষ্কার করলাম- নাফির গালটা ফুলে গেছে ওর ক্রমাগত স্বঘাতের ফলে। জয়ী, ভাইয়ার দেয়া সেই জামা-কাপড় পরে, ভয়ে গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে বিছানার কোণায়- দেয়াল ঘেঁষে। আমার ছেঁড়া টি-শার্টটা নতুন করে আরো দু’জায়গায় ছিঁড়েছে। বীনা ক্লান্ত শরীরে বারবার রান্নাঘরে যাচ্ছে আসছে আর একটু পর পর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে- উফ্ শব্দে। কিন্তু আমি সে’দিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক আবিস্কার করে দারুণ হালকা বোধ করছি ভবিষ্যতের যুদ্ধের কথা ভেবে। সেটা হলো- ওর হাত দু’টোকে বেঁধে নিয়ে ল্যাং মেরে ওকে বিছানায় শুইয়ে ভাল করে ঠান্ডা পানি দিয়ে শান্ত না-হওয়াবধি মুছতে থাকা। ঠেসে ধরে নিয়ন্ত্রণের কৌশলটা অনেকেই প্রয়োগ করে। আর আমি সেটা শিখেছিলাম ইউটিউব থেকে। সেটার সাথে প্রচুর শক্তির অপচয় ঘটে। কিন্তু আমার সদ্য আবিস্কৃত এই কৌশলটা অনেক ভাল কাজ করেছে। আসলে যে পরিবারে একটা অটিষ্টিক সন্তান থাকে সে পরিবারে প্রায় প্রতিটি দিনই হয় যুদ্ধের। আর আমাদের পুরো জীবনটাই তাই যুদ্ধের কাল! কিন্তু বারবারই হেরে যাই নিজের কাছে যখন ভাবি- আমার এবং বীনার মৃত্যুর পরে- নাফির কী হবে! (চলবে)

৬ষ্ঠ পর্বঃ আমার চোখে নাফি (১)

এক।।
বৈশাখ প্রায় শেষ। আজ ৩০ তারিখ। গ্রীষ্মের দাবদাহ চলছে। আকাশের ছেঁড়া-ছেঁড়া ছাই-সাদা মেঘগুলোতে কোন আশার বারতা নেই। ঢাকার তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ঘরের ভিতরে বাতাসটাও গরম। উপরি হিসাবে আছে নিয়মিত লোড শেডিং। প্রচন্ড গরমে গত কয়েক রাতে ঘুম হয়নি কারো ঠিক মত। লোড শেডিং হলে আমার কাজ হলো- বিছানায় সবাইকে এক জা’গায় জড়ো করে- হাতপাখা চালিয়ে বাতাস করা। সেই সংগে, বিদ্যূৎ আসা পর্যন্ত, একটার পর একটা রবীন্দ্র সংগীত কিংবা দেশাত্মবোধক গান গাওয়া। নজরুল গীতিও মাঝে মাঝে কিছু হয়। জয়ীর পছন্দ ভূপেন। কিন্তু নাফি ধীর লয়ের গান পছন্দ করে। এটা ওকে শান্ত রাখে। আমার গানের তালে তালে নাফি ভীষনভাবে শরীর এবং মাথা দোলাতে থাকে। দুলতে দুলতেই সে আমার চোখ আর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এ’সময়ে, গানের সংগে- আমি প্রায় ৩ ঘন্টা বিরতিহীনভাবে হাত পাখা চালাতে পারি।
এটা ঠিক যে, প্রচন্ড গরম কিংবা ঠান্ডা- যে কারো জন্যেই সমস্যা। কিন্তু অনুভূতিগত স্পর্শকাতরতার কারণে নাফির সমস্যা অনেক গুণ বেশী। তার হাইপারনেস বেড়ে যায়। বিছানা, বালিশ আর জানালার পর্দা ছিঁড়ে পরিবেশের প্রতি অসহনীয়তা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে। ভয়ন্কর চিৎকার করতে-করতে নিজেকে আঘাত করে। আমি স্টেপ ওয়ান, টু, থ্রী, ফোর কৌশলগুলো একটার পর একটা প্রয়োগ করতে থাকি। কোনভাবে যদি কোনটায় তার কষ্ট লাঘব হয়- এই চেষ্টায়। ইদানিং তার হঠাৎ-করা দুম-দাম আঘাতগুলো নির্বিকার হজম করি। মনে হয়- এতে তার ভিতর থেকে বিষ কিংবা চাপ বেরিয়ে যায়। যাক না। আমিও তো তাই চাই। সেক্ষেত্রে, আমার পকেটে কৌশলের সংখ্যা বেড়ে হবে পাঁচ। সেটাও তো এক বিশাল পাওয়া।
দুই।।
বিকেল চারটা। নাফি আমার হাত ধরে নিয়ে গেল তার সেন্ডেল-স্যু’র কাছে। মানে- “আমাকে বাইরে নিয়ে চলো।” অথচ সে আগে কখনোই বাইরে যেতে চাইতো না। ইদানিং ২/৩ বার করে যাচ্ছে। মারাত্মক কোন সমস্যা না থাকলে, সব সময়েই ওর আবেদনে আমি সাড়া দেই। সেটা- দিন রাত ২৪ঘন্টার যে কোন সময়ে। কারণ- আমি তার key person. অটিষ্টিক বেবীদের জন্যে সংসারে একজনকে key person-এর ভূমিকা পালন করতে হয়। আমি তাকে সবচে’ বেশী সঙ্গ দিব এবং তার সব কথা যতটা সম্ভব- মানবো। অন্যরা ওর যে কথা মানতে চাইছে না, আমার মাধ্যমে, সে অন্যকেও তার সেই ইচ্ছাটা মানতে বাধ্য করতে পারে। বিনিময়ে নাফিও আমার কথা যতটা সম্ভব শুনবে। যেমন- ঠিক এই মুহুর্তে আমি যে ফুলহাতা জামাটা পরে আছি- সেটা আসলে শীতের পোশাক। কিন্তু আমার জ্বর হয়নি বা শীত করছে না। এটা আসলে- ওর সিকোয়েন্স সম্পর্কিত স্পর্শকাতর একটা বিষয়। জামাটার ডান হাতের কনুই এবং কোমরের একটু উপরে কিছুটা সেলাই ছুঁটে গিয়ে হা হয়ে গেছে। বাতিল যোগ্য হয়েছে বহু আগেই। জামাটা আমি গতকাল থেকে পরে আছি এবং ভেজাই পরতে হয়েছিল। কালো যে ট্রাউজারটা পরে আছি, সেটার সামনের দু’টো পকেটই ছেঁড়া। ফোন, কলম, টাকা, চাবি- সব পড়ে যায় সেখান থেকে। আসলে এটা মোটেও কোন সমস্যা নয়। আমার শখ, সমাজ কিংবা আরামের চাইতে ওর সিকোয়েন্স ঠিক রাখাটা অনেক বেশী জরুরী। সিকোয়েন্স ঠিক না থাকলে, ও হাইপার হবে। আর, হাইপার হলে, মুহুর্তের মধ্যে বাড়িটাকে সে নরক বানিয়ে ফেলবে। সবচে’ বড় কথা নিজেকে আঘাত করবে। ভয়ন্কর আঘাত। তাই, ছেঁড়া জামা-কাপড়ই সই। সে নিজেও সাদা যে টি-শার্টটা পরে আছে, সেটা মলিন এবং পেটের কাছে বেশ খানিকটা জায়গায় তরকারীর ঝোল লাগানো। তার পিঠ চুলকাতে হয় জামার উপর দিয়ে। সরাসরি ত্বকে- সে সহজে অন্যের ছোঁয়া নিতে পারে না। কিন্তু সে নিজেই যদি চুলকানোর কাজটা করে তাহলে তার চামড়া কিংবা জামার কিছু অংশ ‘নেই’ হয়ে যেতে পারে। সে’কারণে এই টি-শার্টের পিঠের দিকে দু’টো জায়গায় চোখে পড়ার মত বড় বড় ফুটো আছে। ওর পরনে কালো ট্রাউজার। সেটার ইলাস্টিকের টেম্পারমেন্ট হারিয়ে ঢিলা হয়ে গেছে বহু আগেই। ডান হাতে তার খেলার কার্ড থাকে বলে, বাম হাতে সে একটু পর পর ট্রাউজারটা টেনে বসিয়ে নিচ্ছে কোমরে। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই কোমর ছেড়ে আবার নেমে যাচ্ছে সেটা। অথচ আলমিরায় তার প্রচুর ভাল-ভাল জামা কাপড় রয়েছে। বিন্দু মাত্র আকর্ষণ নেই তার সে’সবের জন্যে। বাইরে হাঁটার সময়ে তার ট্রাউজারটা একটু পরপর টেনেটুনে কোমরে বসানোর কাজটা আমাকে করতে হয়। আর- কিছুক্ষণ পরপর গামছা দিয়ে তার ঘাম মুছতে থাকি। প্রচুর ঘামে সে।
আমাদের জামা কাপড়ের বেহাল এই দশা দেখে, এ’পাড়ায় কে কী ভাবছে- তাতে আমাদের কিছু এসে যায় না। এমন কি আপনারও খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু সত্যি বলছি- আমাদের একটুও খারাপ লাগছে না। আমরা বেশ সুখী মানুষ। গরম কালে শীতের পোশাক পরে দিব্যি গান গাইছি। হাসছি। এবং দিন পার করছি। যেহেতু আমি সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছি, তাই বৈরী কোন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর শক্তিও আমার বেশী। কিন্তু সমস্যাটা হয়েছে জয়ীকে নিয়ে। তার ভীষন মন খারাপ। ছোট্ট এই মানুষটা ঘুরে ফিরে এমন একেকটা মন খারাপ করা প্রশ্ন করতে থাকে যে-তার জন্যে মায়া হয়। সে প্রশ্ন করে- “দীপু, আমি কী আর কোন দিন আমার ইচ্ছে মত পোশাক পরতে পারবো না?” অথবা তার মায়ের কাছে জানতে চাইবে- “বীনু, আমি কী আমার ঈদের জামা পরতে পারবো না?” কিংবা হয়তো কাঁদো-কাঁদো হয়ে আমাকে বলবে- “তুমি ভাইয়াকে বলে দাও- আমি এখন থেকে আমার ইচ্ছে মত পোশাক পরবো।”
যে কারণে এত সমস্যা হয় তাহলো- সিকোয়েন্স অনুসরণ ছাড়াও, অটিষ্টিক মানুষরা পুরোনো জিনিষগুলোর প্রতি তীব্র অাকর্ষণ বোধ করে এবং তাদের নিত্য ব্যবহৃত জিনিষগুলোর সাথে সহজাতভাবেই একান্তের একটা সখ্যতা তৈরী করে। একই রং, সাইজ এবং ডিজাইনের ৩টি পোশাক আপনি কিংবা আমি হয়তো পার্থক্য নাও করতে পারি। কিন্তু নাফি পোশাক ৩টির মধ্যকার পার্থক্য খুব সহজেই ধরতে পারবে এবং মনে রাখতে পারবে। তাই কখন কোনটা পরছি বা পরবো সেটা চিনতে কিংবা নির্বাচনে- একটিবারেও তার বিন্দুমাত্র ভুল হবে না। এটা শুধুই প্রকৃতিপ্রদত্ত একটি বিশেষ শক্তি যা তার মধ্যে আছে। আর, পুরোনো জিনিসের প্রতি তীব্র এই আকর্ষণ- একটা অদ্ভূত illusion–ও বটে, যা অটিষ্টিক মানুষরা তীব্রভাবে অনুভব করে। ফলে, তার নিত্য ব্যবহৃত জিনিষপত্রগুলোকে রক্ষার জন্যে নিজেকে সে বিপদজনকভাবে আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে। সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রেও পুরোনো জিনিষের প্রতি এমন অনুভব কম-বেশী থাকে। সেই একই অনুভূতি সহজাতভাবে ওদেরও থাকে- কিন্তু অনেক বেশী মাত্রায়। যে কারণে, আমরা অনেক চেষ্টা করতে করতে, অনেক দেরীতে নাফিকে শীতকালের পোশাক শীতকালে পরাতে পারি। আবার শীত চলে গেলে, গরমের পোশাক পরার ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। এপ্রিল-মে’র প্রচন্ড গরমেও সে ঘামতে ঘামতে ব্লান্কেট ব্যবহার করতে থাকে। আর এ’সব কিছুই তাকে একটা নিরাপত্তা বোধ এনে দেয়।
তিন।।
বাইরের জগতটা তার কাছে ভীষণ রকমের বিশৃঙ্খল। সেখানে সে চরম অস্বস্তি এবং অনিরাপদ বোধ করে। ঘরের মত বাইরেও তার সাথে, তার খুব কাছের একজনকে থাকতে হয়। সে, বাসা থেকে সামান্য দূরেও, রাস্তায় হাঁটার সময়ে এতটাই ভয় পায় যে কাছের মানুষটাকে দু’হাতে শক্ত করে জাপটে ধরে। পাছে তাকে যদি ভুল করে ফেলে চলে যায়! কারণ সে জানে- সে কোনদিনই ঠিকমত রাস্তা চিনতে পারবে না। অপরিচিত কাউকে নিজের কথাটা বুঝিয়ে বলতে পারবে না। এবং এই পৃথিবীতে কেউ তাকে বুঝবে না। ফলে সে শিশুর মতই আতংকগ্রস্থ হয়ে তার সাথের মানুষটাকে শক্ত করে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে এবং অস্থিরভাবে চারদিকে তাকাতে তাকাতে- এলোমেলো পা ফেলে ছন্দহীনভাবে হাঁটতে থাকে। সে এতটাই জোরে জড়িয়ে ধরে যে তার দু’হাতের চাপে তখন ঠিকমত হাঁটাও দুরূহ হয়ে পড়ে। এটা সত্যি যে- রাস্তায় সে একা হয়ে পড়লে, কোনদিন সে আর বাড়ি ফিরতে পারবে না। এটা ওর জীবনের একটা মর্মান্তিক সত্য যা সে জানে এবং সে’কারণে আতংকিত বোধ করে। ৭/৮ বছর আগে শাহবাগের শিশু পার্কে নাফি একবার হারিয়ে গিয়েছিল। প্রায় সাথে সাথেই টের পাই আমরা। প্রথমেই এক দৌড়ে মেলার একমাত্র প্রবেশ পথে যেয়ে গেটম্যানদের সাবধান করি। সেখান থেকে দৌড়ে যেয়ে কন্ট্রোল রুমে জানাই। খুঁজতে খুঁজতে কিছুক্ষণ পর, সৌভাগ্যবশতঃ আমিই নাফিকে পেয়ে যাই।
নাফির চে’ ৫/৬ বছরের ছোট এক অটিষ্টিক ছেলে কোনভাবে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সে কোনভাবেই বাসায় ফিরতে পারছিল না। আর খারাপ ছেলেরা পাগল মনে করে তার জামা-কাপড় খুলে নিয়েছিল। নেংটো এবং অসহায়, ঠিক কতটা অসহায় আর আতংকিত হয়ে সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছিল- আমি সেটা কল্পনাও করতে পারি না। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে তার বাবা-মার কাছে পৌছে দেয় সেইদিনই। আমি ভীষণ আঘাত পেয়েছিলাম ঐ ঘটনা শোনার পর। আমি সেই ছেলেটার জায়গায় নাফিকে কল্পনা করি আর শিউরে উঠি। কোনদিন, কোনভাবে যদি নাফি হারিয়ে যায়… কেউই ওকে বুঝবে না। এ’দেশের যে সামাজিক চিত্র- তাতে ওকে পাগল ভেবে ভুল করবে সবাই। এবং সবাই ওরকম আচরণও করবে নাফির সংগে। …আমি আর ভাবতে পারি না। (চলবে)

৫ম পর্বঃ হাসির অন্তরালে (আত্মকথাঃ ফারহান আরিফ নাফি)

এক।।
লোকটা ঠিক আমার পিছনে পিছনে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। আমার থেকে দু’হাত সামনেই দীপু পাপা। লোকটার দিকে আমার মনোযোগ রয়েছে। সে আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন আমরা বেশ পরিচিত। অথচ মনে হচ্ছে তাকে আমি আগে কখনো দেখিনি। তার ঠোঁটের কোণায় হাসি। হতে পারে সে আমাকে চিনে। কিন্তু সে যে স্বস্তিতে নেই এবং সেটা আমার কারণে- সেটা বুঝেছি প্রথমবার তার দিকে তাকানোর পরই। অথচ সে কি-না হাসছে! তার অবস্থাটা দেখে আমার হঠাৎ হাসি পেল। তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। তার বোকা বোকা হাসিটা আরো বেড়ে গেল। তা দেখে আমার হাসিও বেড়ে গেল। আমি বেশ বুঝতে পারছি আমাকে দেখে সে “বিপদগ্রস্থ হাসি” হাসছে । এবার আমি শব্দ করে হাসতে শুরু করলাম। আমি হাসলেও বিল্ডিংটা গমগম করতে থাকে। সিঁড়িতে সেটা আরো বেশী হয়। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। হাসি পেলে আমি চট্ করে থামাতে পারি না। হাসতেই থাকি। দীপু একটুও না হেসে, শান্তভাবে লোকটাকে বললো – “ওর পিছনে পিছনে কেউ উঠছে, এটা ও পছন্দ করে না।” কথাটা ঠিক। দীপুর কথা শুনে লোকটা প্রায় থেমেই গেল। কিঞ্চিত ভয় মেশানো অস্বস্তিতে পড়ে গেল লোকটা এবার। মজার ব্যাপার হলো- তবু মুখটা সে জোর করে হাসি হাসি করে রেখেছে। তা দেখে আমার হাসি থামতে চাইছে না। আমি শব্দ করে হেসেই যাচ্ছি। ছয় তলা বিল্ডিং-এ আমাদের বাসাটা তিন তলায়। লোকটাকে খেয়াল করতে করতে দোতলা পর্যন্ত ওভাবেই উঠার পর হাসিটা একটু থামাতে চাইলাম। বারবার তবুও, বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত উপচে আসছে হাসির একেকটা ঢেউ। কোনরকমে নিজেকে সামলাতে সামলাতে- লোকটার আরো কাছ থেকে, তার চোখের ঠিক আরো গভীরে দেখার জন্যে, উপরে না উঠে- হঠাৎ তার দিকে যেতে শুরু করলাম। লোকটা প্রথমে থেমে গেল। এরপর একপা পিছিয়ে গেল। ভয় পেয়েছে! আমার হাসি চলে আসছে আবারো। এ’সময়ে হঠাৎ পিছন থেকে দীপু পাপা আমার হাত ধরে ফেললো- “আব্বু, কাম অন।” দীপুর কথা শুনে আমি নিজেকে সামলে আবারো উঠতে শুরু করলাম। কিন্তু হাসি থামাতে পারছি না। হা হা করে হাসতে হাসতে সিঁড়ি ভাঙছি। আমার শরীর বাঁকা হয়ে যাচ্ছে হাসির দমকে। ওভাবেই হাসতে হাসতেই বাসায় ঢুকলাম। বাসায় ঢোকার পরও আমার হাসি থামাতে পারছিলাম না অনেকক্ষণ পর্যন্ত। কিন্তু আমার হাসির এ’সময়ে, সবাই গম্ভীর হয়ে যার যার কাজ করছিল।
দুই।।
পেশাব পেলে আমার সাংঘাতিক হাসি পায়। হাসতে হাসতে আমার চোখ ফেটে পানি বেরুতে থাকে। সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে আমি হাসতে থাকি। ঘামতেও থাকি। কিন্তু এই হাসি থামানোর সাধ্যি তখন আমার থাকে না। এটা ঘটে আমার অনুভূতিগত জটিলতার কারণে। এ’সময়ে সবাই হয়তো যে যার মত কাজে ব্যস্ত। অথচ আমি হয়তো পড়ে গেছি তখন নিয়ন্ত্রণহীন এক কাতুকুতুর গর্তে। যে গর্তে পড়লে আমার হাসি আর থামাতে পারি না। আমার বীনু আম্মু অনেক ছোট বেলাতেই আমার এই সমস্যাটা ধরতে পেরেছিল। হাসতে হাসতে আমি অনেক সময়ে, তখন প্যান্টেই পেশাব করে দিতাম। এরপর থেকে আমি হাসলেই, সবাই বুঝতে চাইতো আমার পেশাব পেল কি-না। বাথরুমে গিয়ে আমি হাসতে হাসতে পেশাব করতে থাকি। তবে সবসময়েই যে পেশাব পেলেই হাসি পায় –এমনটা নয়। আমি বেশীরভাগ সময়েই স্বাভাবিক পেশাব করতে পারি। যদিও আমাকে রুটিনমাফিক এ’কাজটা করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু অনেক সময়েই পেশাব না- পেলেও, নিয়ন্ত্রণহীন হাসির কারণে- দীপু কিংবা বীনু আমার হাত ধরে জোর করে টানাটানি করতে থাকে আর বারবার বলতে থাকে- “নাফি বাথরুমে যাবে। পিসু করবে। আসো। কাম অন।” অথচ তখন হয়তো আমি হাসছি অন্য কোন কারণে। কিন্তু ভুল করে টানাটানি করলে, আমি হাসিটা কোনভাবে থামানোর জন্য যুদ্ধ করি নিজের সাথে। সেটা যতক্ষণ না-পারি ততক্ষণ আমাকে নিয়ে টানাটানি চলতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত আমি কোনরকমে কয়েক মুহুর্তের জন্য হাসি থামাতে পারি। তখন বুঝতে পেরে আমাকে যেই ছেড়ে দেয় অমনি আমার অনেক কষ্টে আটকে রাখা হাসি হুড়মুড় করে আবারও ছিটকে বেরিয়ে আসে। এভাবে অনেকটা সময় ধরে নিজের সাথে নিজেকেই যুদ্ধ করতে হয় এই হাসি থামানোর জন্যে। সামলাতে হয়- নিজেকেই নিজে।
তিন।।
অনেক ছোট ছোট আনন্দ-ও অনেক সময়ে, বেশী অনুভূত হয় আমার কাছে। যে আনন্দে একজন সাধারণ মানুষ মনে মনে শুধু মৃদু খুশিই হতে পারে, সেই একই আনন্দে আমি হয়তো বিশাল একটা লাফ দিয়ে, তীব্র চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করতে পারি এবং অনেকক্ষণ হাসতে পারি। অনেক সময়ে এমনটা ঘটে যে- কিছু একটা চাইতে গিয়ে কিংবা কাউকে কিছু একটা বোঝাতে গিয়ে আমি একটা জটিলতার ভিতরে পড়ে যাই। কিন্তু হঠাৎ যদি সেটা সহজেই মিটে যায়- তাহলেও কিছুক্ষণ হাসতে পারি। কিন্তু এটাও অনেক সময়ে ঘটে যায়- যে কাঁদতে যেয়ে হেসে ফেলেছি। যেটা শুধুই আমার প্রকাশ করার অক্ষমতা এবং অনুভূতিগত জটিলতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। আবার- সবার অলক্ষ্যে বিছানায় শুয়ে মাস্টারবেশন করার পর অদ্ভুত আনন্দদায়ক এবং তীব্র যে অনুভূতি আমার সমস্ত শরীর এবং অস্তিত্বে ছড়িয়ে পড়ে- তাতে আমি অনেক সময়েই হেসে ফেলি। সেটা কিন্তু নিঃশব্দ হাসি। আমার এমন নিঃশব্দ হাসি দেখে দীপু পাপা এগিয়ে আসে এবং আমার গোসলের ব্যবস্থা করে।
বাসায় রুটি বানাতে আসে যে মানুষটা বীনু এবং দীপু তাকে খালা বলে ডাকে। সেই বয়স্ক মানুষটা একটা ছন্দে কাজ করে। সে যখন এই রুটি বানানোর কাজটা শুরু করে আমি তার পাশে একটা টুলে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখতে থাকি। সে একটা সিকোয়েন্স অনুসরণ করে যখন কাজটা করে, তখন শেষের দিকে এসে অনেক আনন্দে আমি তার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসতে থাকি। কিন্তু সে হাসে না। আমি একা একাই হাসতে থাকি। আবার, এমন অনেক হাসির কারণ আছে যা দীপু পাপা কিংবা বীনু আম্মু এখনো জানে না- কেন হাসতে হাসতে আমার চোখে পানি চলে আসে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। (চলবে)

৪র্থ পর্বঃ প্রকৃতির আবর্ত-(২) আত্মকথাঃ ফারহান আরিফ নাফি

এটা মাত্র ক’দিন আগের কথা। গভীর রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে। আমি বসে আছি। দীপু পাপা সাধারণতঃ ঘুমায় ভোর বেলায়। কিন্তু আজ সেও ঘুমিয়ে গেছে। আমি খেয়াল করলাম বীনু-আম্মু, দীপু-পাপা এবং জয়ী কেউ-ই সঠিক পোশাক পরে নেই। অথচ আমি ঘুমানোর আগেও দেখেছিলাম সব ঠিক আছে। তারমানে হলো-আমি ঘুমানোর পরেই, সবাই পোশাক পাল্টে ফেলেছে। মানে সিকোয়েন্স ভেঙ্গে ফেলেছে। আমি অন্ধকারেই একা একা বারান্দায় গিয়ে সবার পোশাকগুলো খুঁজে নিয়ে আসলাম। এরপর দীপুর হাত ধরতেই সে উঠে বসলো এবং বুঝে ফেললো কি করতে হবে। সে কোন কথা না-বলে, দ্রুত আমার হাত থেকে নিয়েই তার ডেনিম জিনসের প্যান্ট আর ছাই রঙের টি-শার্টটা পরে ফেললো। বাকী রইলো বীনু-আম্মু আর জয়ী। আমি কী বলতে চাইছি, দীপু পাপা সেটা বুঝতে পেরেই বীনুকে ডাক দিয়ে পোশাক পাল্টাতে বললো। বীনু তার পোশাক হাতে নিয়েই আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বললো- “এখন রাত বাজে ৩টা। পোশাক পাল্টানো যাবে না।” এরপর ধমকের সুরে আমাকে বললো- “ঘুমাও।” আমার হয়ে দীপুই বললো- “আহা, এমন করো কেন? পরো না, ভাই। পরলেই তো ঝামেলা মিটে যায়।” বীনু আরো বিরক্ত হয়ে বললো- “আমি এখন ভেজা জামা-কাপড় পরবো নাকি? বললেই হলো? এই ভেজা জামা পরলে আমি সুস্থ থাকবো? সকালে আমার স্কুল আছে।” বীনুর জামাটা হাতে নিয়ে আমি ঠোঁটে ছোঁয়ালাম। সেটা সত্যিই ভেজা ছিল। দীপুরটাও সামান্য ভেজা ছিল। কিন্তু সে ভেজাটাই পরে ফেলেছে। আমাদের কথার তোড়েই জয়ী উঠে বসেছে। ভয়ার্ত চোখে দেখছে সবাইকে। জয়ীর জামাটাও ভেজা ছিল। বুঝতে পারছি আমার কথা কেউ শুনবে না। এবং প্রচন্ড রাগে ঠিক তখনই আমি নিয়ন্ত্রণ হারালাম। প্রচন্ড চিৎকার দিয়ে প্রথম আক্রমন করলাম- দীপুকে। অনবরত মারতে থাকলাম আর খামচাতে থাকলাম ওকে। সে ল্যাং মেরে ফেলে দিল আমাকে আমার বিছানায়। এরপর চেপে ধরলো আমাকে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে। আমি গগনবিদারী চিৎকার করতে থাকলাম। চিৎকার থামাতে দীপু সব শক্তি দিয়ে আমার পেটের উপরে বসে- তার দুই হাঁটু আর বাম হাত দিয়ে, আমার দুই হাত চেপে ধরলো। ডান হাতে চেপে ধরলো আমার মুখ। কয়েকটা মূহুর্ত কেটে গেল চুপচাপ ওভাবেই। এরপর আমি সহজ হয়েছি ভেবে সে ছেড়ে দিল আমাকে। কিন্তু আমি আসলে সহজ হতে পারছি না। বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত প্রচন্ড রাগ উথলে উঠছে আমার। হঠাৎ করেই চিৎকার করতে করতে নিজের মাথায় জোরে জোরে মারতে শুরু করলাম। দ্রুত এসে দীপু পাপা আবার চেপে ধরলো আমাকে। আমিও সমস্ত শক্তি দিয়ে সুযোগ মত মারছি ওকে। সে এরপর আমার মাথায় থাপ্পড় মারলো অনেকগুলো। কিন্তু এটা সে করে আমাকে ভয় দেখানোর জন্যে এবং অনেক সময় রাগের থেকেও করে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে- একই সাথে এই দু’টো কারণেই সে মারছে আমাকে। তাতে আমার রাগ আরো বেড়ে গেল। তীব্র রাগের যন্ত্রনায় আমার সমস্ত শরীর ভয়ন্করভাবে কাঁপছে। আমার চিৎকার থামাতে আগের মতই কৌশল করে, দীপু আমার মুখ চেপে ধরলো। কিন্তু এবার সে এত জোরে চেপে ধরেছে যে- দাঁতের সাথে প্রচন্ড চাপে আমার ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে আসছে। এই মূহুর্তে ওকে আমার প্রাণের শত্রু মনে হচ্ছে। আমার বিষ্ফোরিত রক্তলাল চোখে তাকিয়ে আছি দীপুর চোখে। দীপুর টি-শার্টটা অনেক আগেই একটানে ছিঁড়ে ফেলেছি। ছেঁড়া জামাটা বিশ্রীভাবে তার গায়ে ঝুলছে। ওর চোখেও এখন অনেক রাগ, সাথে সামাজিক ভয়। কারণ আশেপাশেই কোন বাচ্চার ঘুম ছুটে গেছে আমার চিৎকারে। ভয়ার্ত কান্নার আওয়াজ শুনছি। অনেক মানুষের কথাও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সে’সব আমাকে স্পর্শ করছে না। এবং আমার রাগ কিছুতেই কমছে না।
আমাকে নিয়ন্ত্রনের প্রথম ধাপটা হলো বিছানার সাথে কিছুক্ষণ চেপে ধরে রাখা। এরপর ভেজা গামছা দিয়ে আমার চোখ মুখ এবং মাথা মুছে দেয়া। সেটা করতেই- দীপু তার দুই হাটু দিয়ে আমার দুই হাত চেপে ধরে রেখেছে। বাম হাতে চেপে ধরেছে আমার মুখ- যেন চিৎকার করতে না-পরি। এই অবস্থাতেই, হাঁপাতে হাঁপাতে সে বীনুকে বললো- “তাড়াতাড়ি গামছাটা ভিজিয়ে আনো। বীনু দ্রুত ভেজা গামছাটা ধরিয়ে দিল দীপুর হাতে। সে আমার মুখ চোখ এবং মাথা ভেজা গামছাটা দিয়ে মুছে দিতে থাকলো। একটু পরে আমি ঠান্ডা হয়েছি ভেবে যেই মাত্র দীপু আমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে অমনি হ্যাঁচকা এক টানে জানালার পর্দা খুলে ফেললাম। রাগ হলে পর্দাটা এভাবেই ছিঁড়তে চেষ্টা করি বলে, আমাদের বাসার সমস্ত পর্দাগুলো কাপড় নাড়া ক্লিপ দিয়ে লাগানো থাকে- আমি টান মারলে যাতে ছিড়ে না-যায়। কারণ, অতীতে অনেক পর্দা আমি ছিঁড়ে ফেলেছি। বালিশ কামড়ে ছিঁড়ে আমার শরীর আর ঘর তুলাময় করে ফেলেছি। পর্দাটা ছিঁড়লো না বলে এরপর নিজের হাতে নিজেই ভয়ন্কর এক কামড় বসিয়ে ধরে রাখলাম অনেকক্ষণ। অনেক অটিষ্টিক বাচ্চাই, যারা হাইপার একটিভিটি- তারা এটা করে। নিজের হাতে নিজেই কামড় বসিয়ে দেয়। এ’কারণে তাদের হাতে সারাজীবনই কামড়ের কালচে দাগটা থেকে যায়। আম্মু বলে- অটিষ্টিক মানুষরা বেশীর ভাগই অশান্ত গোছের হয়। হাইপার এক্টিভিটিস যারা দেখায়- তাদের সংখ্যাই বেশী। আর, আমিও সেই দলেরই একজন। মাঝে মাঝেই, আমিও হাইপার হয়ে পড়ি।
এখন- যেহেতু আমার রাগ কমেনি এবং চিৎকারও থামেনি। তাই চিৎকার থামাতে বারবার দীপু আমার মুখ চেপে ধরছে। নানা রকম চেষ্টা করছে। ভয় দেখাচ্ছে। আমি বিছানায় আধ শোয়া অবস্থাতেই ডান হাত দিয়ে আমার নিজের কান-মাথা জুড়ে ভয়ন্কর জোরে থাপ্পড় মারতে থাকলাম নিজেকেই। সেই সংগে মাঝে মাঝে দেয়ালে হাঁটু দিয়ে এত জোরে জোরে আঘাত করছি যে দুম দুম করে পুরো বিল্ডিং জুড়ে বিশাল শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, পুরো বিল্ডিংটাই কাঁপিয়ে দিচ্ছি আমার হাঁটুর আঘাতে। আমাকে থামাতে না-পেরে, একসময় দীপু জোর করে আমাকে বাথরুমে নিয়ে গেল। আমার উপরে এটা তার দ্বিতীয় কৌশল। এই সময়ে সে মগ ভরে ভরে প্রচুর পানি আমার মাথায় ঢালতে শুরু করলো। আমার রাগ আরো বেড়ে গেল। আমি সুযোগ পেলেই দীপুকে মারছি। এবং চিৎকার করছি। ভয়ন্কর চিৎকার। আমাকে ভয় দেখাতে গিয়ে আমার গায়ের টি শার্ট্ টাও দীপু ছিঁড়ে ফেলেছে। আমার যেহেতু মারামারির কৌশল জানা নেই, তাই ওর সাথে পেরে উঠছি না। কিন্তু শক্তিতে আমি দীপুর চেয়ে অনেক বেশী। সুতরাং শক্তি এবং নিয়ন্ত্রণহীন রাগের কারণেই আমি কিছুতেই হাল ছাড়তে রাজী না। দীপুর ডান হাতের কনুইয়ের চামড়া ছিঁড়ে নিয়েছি অনেকটা। আমারও চামড়া ছঁড়ে গেছে কয়েক জায়গায়। জ্বলছে কিন্তু জ্বলুনীটা গায়ে মাখছি না। কোন কৌশল কাজ না-করাতে, দীপু এরপর শুরু করলো পানি দিয়ে আক্রমন। মগে ভরে-ভরে পানির বাড়ি মেরে বেশ কয়েকবার আঘাত করলো আমাকে। কয়েক মগ পানিও মাথায় ঢাললো এই সময়ে। কিন্তু আক্রোশ কমলো না আমার। দু’জনেই ভিজে এক শা। এরপর আবার জোর করে বাইরে নিয়ে এলো আমাকে। মারতে থাকলাম দু’জন দু’জনকে। এবার অনেকটা শক্তি হারিয়েছি আমি। তাই আমার চিৎকারও তখন কিছুটা কমে গেছে।
এখানে, যে কথাটা আমার বলা দরকার, তাহলো- আমাদের এক অন্যকে করা- কারো আঘাতই কিন্তু বাস্তবে তেমন জোরালো হয় না। আমার ক্ষেত্রে যা হয়- তাহলো শক্তি আছে কিন্তু প্রয়োগের ব্যর্থতার কারণে সেটা হয়ে যায়- একটা মধ্যম শক্তির কিলের মত। আর যেটা পারি তাহলো- খাঁমচে রক্ত বের করে দিতে পারি। বেশীর ভাগই করি বীনু কিংবা দীপুর হাতে আর পিঠে। দীপু আমার আঘাতগুলো ব্লক করতে পারে। কিন্তু বীনু সেটা পারে না। তাই রাগ হলে ইচ্ছে মত বীনুকে খামচে ধরে রক্তাক্ত করি। আম্মুর হাতে আমার খামচির আঘাত সব সময়ই যে কেউ দেখতে পাবে। দীপু যে আঘাতগুলো আমাকে করে- সেটা হয় ঠাস্-ঠুস্ থাপ্পড় টাইপের। এবং সে আমার মাথায় আঘাত করে। আমি জানি- “আমাকে ভয় দেখানো কিংবা আঘাত করা” যাই সে করুক না কেন- সেটা সে করে “যেভাবেই হোক আমাকে থামানোর জন্যে।” তবে আমি যখন নিজেকে যখন নিজে আঘাত করি, সেটা সত্যিই ভয়ন্কর শক্তিতে করি। কিন্তু আমার ছোট বোন জয়ীকে কখনো আঘাত করি না। বেশ অনেক বছর আগে, ওর অনেক ছোটবেলায় একবার শুধু আঘাত করেছিলাম। দাঁত মুখ খিঁচে, ই-ই-ই করতে করতে ওর হাতের নরম মাংশ পেশীতে প্রচন্ড একটা চিমটি দিয়েছিলাম। ও তখন অনেক কান্না করেছিল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার অনেক খারাপ লেগেছিল। এরপর আমি হঠাৎ করেই একদম শান্ত হয়ে যাই। আর কোনদিন ওকে আমি আঘাত করিনি। তখন আঘাত করার আর কোন কৌশলও আমি জানতাম না। চিমটি কাটার কায়দাটা আমার সহজাত প্রবৃত্তি থেকে পাওয়া- আঘাত করার একটা কৌশল। আর এটা আমি রেগে যাওয়া মাত্রই, হাতের কাছে যাকে পেতাম তার উপরেই তখন প্রয়োগ করতাম এই কৌশলটা।
যাই হোক, এ’ মুহুর্তে আমাদের দু’জনের যা হচ্ছে- দীপুর মুখে কোন শব্দ নেই। কিন্তু আমার চিৎকার সম্ভবতঃ তখনও আশেপাশের অনেকেই শুনতে পাচ্ছে। আমি ক্লান্ত হচ্ছি কি-না অনেক আশা নিয়ে বারবার দীপু সেটা বুঝতে চাচ্ছে- আমার চোখের দিকে তাকিয়ে। কারণ দীপুর শক্তি প্রায় শেষ। কিন্তু আমি থামছি না দেখেই ঠিক এরপরের কৌশলটাকেই সে শেষ রাউন্ড হিসাবে ধরে নিয়ে আমার সামনে দাঁড়ালো। আমাকে বললো- “মারো আমাকে। কিন্তু তুমি যতটা মারবে আমিও ততটা মারবো তোমাকে।” ইতমধ্যে আমিও অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এবং চিৎকারও করছি না আর। দু’জনের মাঝখানে দূরত্ব এক ফিটের মত। হাপরের মত দু’জনেই হাপাচ্ছি। শুরু হলো রেসলিং ষ্টাইলের ফাইট। মানে- প্রতিরোধবিহীন মারামারি। এই ষ্টাইলে আমি একবার আঘাত করবো, তারপর তার পালা- সেও একবার আঘাত করবে আমাকে। ওর এই কৌশলটা গতবার কাজ করেছিল- বেশ তাড়াতাড়ি। মারপিট থামিয়ে দিয়েছিলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। মেনে নিয়েছিলাম পরাজয়। এবার রাগ পড়ছে না সহজে। হারতেও চাচ্ছি না। তাই দীপুর এই কৌশলটাও কাজ করছে না। আমরা ১০/১২টা আঘাত লেনদেন শেষ করলাম। কিন্তু আমার থামার কোন লক্ষণ নেই। আরো কিছুক্ষণ এইভাবে নিঃশব্দে পালা করে আঘাত বিনিময় করলাম আমরা। শুধু দীপুর নয়, আমারও হাতে আর কোন শক্তি নেই। দু’জনেরই আঘাতগুলো শক্তি হারিয়ে হাস্যকর রকমের দুর্বল হয়ে গেছে। কোন কথা ছাড়াই আরো কিছুক্ষণ চললো এই হাস্যকর আঘাত বিনিময়। শেষের আঘাতটা আমিই করলাম দীপুকে। বিনিময়ে সে আর আঘাত করেনি আমাকে। এভাবেই আমাকে জিতিয়ে দিল সে। কিন্তু আমি তো আসলে হেরে গেলাম। সবার কাছেই। কেউ বুঝলো না আমাকে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি সবার পোশাকের সিকোয়েন্সটা ঠিক রাখার জন্যে। কিন্তু পারিনি। সবাই মিলে জোর করে হারিয়ে দিল আমাকে। তার জন্যে অনেক আঘাত করলো আমাকে।
এরপর, দীপু-পাপা আমার হাত ধরে নরম সুরে বললো বিছানায় চলো। ঘুমাবে এবার। আমি তার কথা মেনে নিলাম বিনা আপত্তিতে। বিছানায় যখন গেলাম তখন প্রায় সকাল হয়ে গেছে। আমি শুয়ে পড়েছি। দীপু পাপা আমার পাশে বসে বারবার আমাকে আদর করছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমার নাকে নাক ঘষছে। মাথায় চুমু দিচ্ছে বারবার। ভালবাসা জানাচ্ছে। ফিসফিস করে বারবার সরি বলছে আমাকে। আমি জানি দীপু-পাপা আমাকে বুঝতে পেরেছিল। তার কথা ভাবতে ভাবতে আমার ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। সবকিছু ভুলে গিয়ে একটু পরেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। (চলবে)